रविवार, 16 अप्रैल 2023

গুরুকূল শোধ ভারতী-তপতী শাসমল

 মহর্ষি দয়ানন্দ -এর বেদভাষ্যতে ধন ও তার প্রয়োগ:---


ডাঃ সত্যদেব নিগমালঙ্কার


পাণিনীর ধাতুপাঠে  ধন ধান্যে ধাতু পঠিত হয়, "যা উৎপন্ন করা, তৈরি করা  এবং ফল দেওয়া এবং বিরক্তিকর  অর্থ বোঝায়।"ধন ধাতুতে অচ্ প্রত্যয় যোগে ধনম্ পদ সিদ্ধ হয়।ধনম্ পদের দ্রব্যম্,বিত্তম্,স্বাপতেয়ম্,রিক্যম্,ঋক্যম্,ধনম্,বসু,হিরণ্যম্,দ্রবিণম্,দ্যুগ্নম্ -এই দশ নপুংসক লিঙ্গ  এবং অর্থ; রা; বিভব; এই তিন পুংলিঙ্গ পর্যায়ক্রমে পড়া হয়।যদিও 'ধনম' পদ সাংসারিক সম্পত্তির জন্য প্রসিদ্ধ, তাই তার অর্থ মেনে ,,,দয়ন্তি ধান্যাদিকমুত্পাদয়তীতি ধনম্ অথবা দধাতি সুখমিতি ধনম্ এই নিরুক্তিগুলি যায়।এর প্রসিদ্ধির কারণে 'উদ্ভট্ট' বলেছেন ----

ধনৈর্নিষ্কুলিনাঃ কুলীনা ভবন্তি,ধনৈরাপদং মানবা নিস্তরন্তি।

ধনেভ্যঃ পরো নাস্তি বন্ধুর্হি লোকে,ধনান্যর্জয়ধ্বং ধনান্যর্জয়ধ্বম্।।


ধন সম্পদ দ্বারা নিম্নকুলের ব্যক্তি কুলীন হয়ে যান, মনুষ্য  বিনা আপত্তিতে পার হয়ে যান,এটা ছাড়া এই জগৎ সংসারে বন্ধু নেই, অতএব ধন উপার্জন করুন,ধন উপার্জন করুন।

বিশ্বকোষে 'ধনম্' পদ গোধনেরও বাচক।সেই সময়ে 'গো' - ধন সর্বোপরি এবং সর্বোত্তম মানা হতো ।মেদিনীকোষকারেরও এই একই মান্যতা । লোকাসম্মুখে  কিছু সময় এভাবেই এসেছে যে ,ধন শব্দ গোধন,গজধন্,অশ্বধন,রধন এবং সন্তোষধন হিসাবেই খ্যাত ছিল।রহীম খানখানা এর আরেকটি সঙ্কেত দিয়েছেন।কাশকৃৎস্ন ধাতুপাঠের টীকাকারে ' ধাতু ধন' ধাতু অন্নবাচী মানেন এবং  'ধনম্ ' অর্থ ভাগ্য বলেন। যদিও উনি 'ধনম্ কে দ্রব্যবাচীও মানেন  কিন্তু পুংলিঙ্গতে 'ধন' পদ পশুবাচীও দেখান। হরিবংশ পুরাণে 'ধনম্'কে স্নেহপাত্র অর্থাৎ গোধনের বাচক মেনে প্রয়োগ করা হয়েছে। বস্তুতঃ ধন জীবনের এক আবশ্যক সাধনা,যার আশ্রয়ে ব্যবহারোপযোগী কার্য সম্পন্ন হয়।এর ছেচল্লিশটি প্রতিশব্দ দ্রবিণম্,দ্রব্যং,বিত্তং,স্বাপতেয়ং,রিক্যম,ঋক্যম্,বসু,হিরণ্যম্,দ্যুগ্নম্, অর্থঃ, রাঃ,বিভবঃ,কাঞ্চনম্,লক্ষ্মীঃ,ভোগ্যম্,সম্পত্, বৃদ্ধিঃ ,শ্রীঃ,ব্যবহার্য,রৈঃ,ভোগঃ,স্বং,মঘং,রেক্ণঃ, বেদঃ, বরিবঃ,শ্বাত্রং,রং,রয়িঃ,ক্ষেত্রং,ভগঃ,ভীলু,গয়ঃ,ইন্দ্রিয়ং,রায়ঃ,রাধঃ,ভোজনং,তনা,নৃম্ণং,বন্ধুঃ ,মেধাঃ, বশঃ, ব্রহ্ম,ক্ষবঃ,বৃত্রং,বৃত্তম্ পদ থেকে জ্ঞানহয় যা বিভিন্ন স্থানে সহায়ক এবং জীবনের অবিচ্ছেদ্য চলন,যা আমরা না  চাইলে  এর থেকে দূর হওয়া যাবে না। বৈদিককোষ  নিঘন্টুতে এই পদের আঠাশটি শ্লোক বর্ণিত করা হয়েছে এবং রেক্ণঃ,মিদুম্,তনা এই পদগুলিকেও মানা হয়।বেদের একবচনে 'মেধা' পদ ধনের  বাচক ও বৃদ্ধি। চার বেদের সংহিতাগুলিতে 'ধনম' পদকে ধনম্,ধনস্য,ধনা,ধনাত্,ধনানাম্,ধনানি,ধনায়, যা,ধনে,ধনেন,ধনেষু,ধনৈঃ এই বারো রূপ প্রায় একশো সাতাশি মন্ত্রে প্রযুক্ত আছে।



মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী দ্বারা রচিত বেদভাষ্যতে বিভিন্ন স্থানে ধনের চর্চা বিভিন্ন রূপে করেছিলেন।ধন এবং ঐশ্বর্যতে কিঞ্চিৎ ভেদ দেখিয়েছিলেন।যেমন পুরোহিত যজমানের ঐশ্বর্য বাড়ান এবং যজমান পুরোহিতের ধনসম্পদ বাড়ান।


यथा पुरोहितो यजमानस्यौश्वर्य वर्यद्धति, तथा यजमानोऽपि पुरोहितोस्य धनं वर्द्धयेत्।


বস্তুতঃ পুরোহিত ঐশ্বর্যসম্পন্ন এবং যজমান ধনসম্পন্ন হন।এই দৃষ্টিকোণ থেকে ঐশ্বর্য বৃদ্ধিদাতা সর্বদা পুরুষার্থী এবং সুশিক্ষিত বাণী দ্বারা যুক্তকারী হন,তবেই ঐশ্বর্যের বৃদ্ধি হবে।যখনই কেউ পূর্বে ঐশ্বর্য প্রাপ্ত করেন, তিনি অন্যকে তা দিতে পারেন। ঐশ্বর্যের বৃদ্ধির কারণে আপ্তজনের সৎকার করা হয়, যেভাবে ব্যক্তি গুণবানও হয়ে যান।বিদ্যা এবং বিনয়ের উন্নতি সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ঐশ্বর্যকে উৎপন্ন করে।প্রচুর ঐশ্বর্যের প্রাপ্তি,ধর্মযুক্ত কর্মের দ্বারাই সম্ভব মনে করা হয়।দুষ্টের সাথে খিত্রতা এবং উত্তম মনুষ্যের সাথে মিত্রতা অগণিত ঐশ্বর্য-প্রাপ্তিরই কারণ। পৃথিবী, সূর্য এবং বায়ুর বিদ্যা দ্বারা ঈশ্বর,জীব এবং প্রাণীদের জানা অর্থাৎ এই বিদ্যা পড়ে পরীক্ষা করে বিদ্বানদের পুরুষার্থী বানানো অনেক ঐশ্বর্যের বৃদ্ধির কারণ।যে মনুষ্য সব প্রাণীদের হিতাকাঙ্খী হন, তিনি অনেক ঐশ্বর্য প্রাপ্ত করেন।কার্যের প্রতি নিরন্তন সশ্রদ্ধ থাকা ঐশ্বর্যৈর কারণ এবং ভাগ্য পরিবর্তনের প্রাপক মানা হয়।


এই প্রকারে ঋষি দয়ানন্দ সরস্বতী ঐশ্বর্য এবং ধনের পার্থক্য করেন যে, ঐশ্বর্যের কারণ পুরুষার্থ, সুশিক্ষিত বাণী, আপ্তজনের সৎকার,বিদ্যা ও বিনয়ের উন্নতি, ধর্মযুক্ত কর্ম,দুষ্টের সাথে খিত্রতা এবং সজ্জনের সাথে মিত্রতা, পৃথিবী, সূর্য ও বায়ুর বিদ্যা দ্বারা ঈশ্বর, জীব এবং প্রাণীদের জানা,সব প্রাণীদের হিতাকাঙ্খী বানানো এবং কাজের প্রতি নিরন্তর লেগে থাকা মান্য করলে, তবেই মনুষ্য ঐশ্বর্যসম্পন্ন হতে পারেন।



ধন প্রাপ্ত করার বিভিন্ন উপায় আছে।বায়ু ও সূর্য দ্বারা সব পদার্থের ক্ষন ইত্যাদি ব্যবহার সম্ভব  হয়,বিদ্বান পুরুষ এই দুটি থেকে অনেক কার্য সিদ্ধ করে ধনকে প্রাপ্ত করে।ধনের কামনার পূর্তি, পরমেশ্বরের উপাসনা ও বিদ্বানদের সঙ্গ করা মহর্ষি মানতেন--


नहि मनुष्याणां परमेश्वरोपासनेन विद्वत्सहवासेन च धनकामपूर्तिर्भवितुं शक्या।


ধন প্রাপ্তির একটি কারণ কালবিভাগ, মনুষ্যরা   প্রাতঃ-কাল থেকে কালবিভাগ অনুরুপ ব্যবহার করলে সুখের সাধন এবং সুখপ্রাপ্ত করতে পারেন। এইজন্য মনুষ্যের এরকম নিত্য জ্ঞান দরকার।এই স্থিতিকে চিন্তা করেই মহর্ষি ধন উপার্জন উপায়ের উপর কালবিভাগের মহত্ব বলতে গিয়ে লিখেছেন----


यथेषुकृता सेना शत्रून् विजयते, तथा धनस्य सदुपायं शोघ्रमेव कुर्यात्। कालविशेषेषु दिनेषु कार्याणि रात्रिभागेषु नोत्पद्यते। 

 মনুষ্যকে ঐ কর্মের অনুষ্ঠান নিরন্তর করা উচিৎ, কেননা অতুল ধন-ধান্য প্রাপ্ত হয়ে সম্মানীয় হওয়ার জন্য ধন-ধান্যের প্রাপ্তি করা অবশ্যম্ভাবী এবং ধন-ধান্য প্রাপ্তির এক সাধন। মহর্ষি বলেছেন অগ্নি প্রধান দিব্য পদার্থের ব্যবহার সিদ্ধির জন্য সম্যক প্রয়োগ করা।

বস্তুতঃ সম্যক সিদ্ধ হয়ে গিয়ে অগ্নি, ধনপ্রাপ্তির নিমিত্ত হন। অনেক প্রচেষ্টা করাই ধনপ্রাপ্তির কারণ এবং এই প্রচেষ্টা মানুষকে ধনী করে তোলে। ধনপ্রাপ্তির এক উপায় হল, রাজপুরুষদের সাথে কখনও বিরোধ না করা এবং ন্যায়পূর্বক ধন উপার্জন করে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করে খরচ না করাও।এই জ্ঞান আসে ,  বিপরীত পরিস্থিতি আসার পর। পরমাত্মার আজ্ঞাতে যে লোক বিদ্যমান থাকে, ধনসম্পদের স্থিরতা তার পাশে থাকে।অতুল সম্পদের  প্রাপ্তি কেবল চার কারণেই  সম্ভব----

১। শরীরকে সুস্থ রাখা।

২।বুদ্ধির পবিত্রতা।

৩।ধর্মাত্মা আপ্ত বিদ্বানদের সাথে কাজ করা।

৪।জিতেন্দ্রিয়তার দ্বারা পূর্ণ আয়ু প্রাপ্ত করা।


বিদ্বানদের সেবা সম্পূর্ণ ঐশ্বর্যের প্রাপ্তি করে।যখন মানুষের সামনে অনেক বাধা  এসে দাঁড়ায়, তখন এই অনেক উপায়ের ব্যবস্থা গ্ৰহণ করা।এই প্রকার পুরুষার্থ দ্বারা বিঘ্ন দূর করা এবং শান্তিকে নিরন্তন বৃদ্ধি করা উচিৎ।




মহর্ষি ধনসম্পদ উপার্জন করার জন্য ধর্মযুক্ত পুরুষার্থ হওয়াকে মান্যতা দিয়েছেন।


हे मनुष्याः!यदि युयं धनमिच्छत, तर्हि धर्मेण पुरुषार्थेन योग्यां क्रियां सततं कुरुत ।।

কতিপয় বিদ্বানদের মান্যতা এটাই যে,বিদ্বান ব্যক্তি ধনবান হননা---विद्वान् धनोर्भुपतिः दीर्घजीवी, কিন্তু মহর্ষি দয়ানন্দ বেদ মন্ত্রের ভাবার্থতে বিদ্বান ব্যক্তির ধনী হওয়ার উপায় স্পষ্ট বলেছেন যে,---ये मनुष्याः इह सृष्टिस्थानां पदार्थानां सुपरीक्षया संयोगवियोगाभ्यां श्रेष्ठांन् पदार्थान् कर्माणि च निष्ठा दयन्ति,ते विद्वद्वरा धनाढ्यतमाश्च जायन्ते।

অর্থাৎ যে মনুষ্য এই জগৎ সংসারের সৃষ্টির পদার্থকে উত্তম পরীক্ষা দ্বারা সংযোগ এবং বিভাগ দ্বারা শ্রেষ্ঠ পদার্থের নির্মাণ করে এবং ভালো কাজ করে, তিনি উত্তম বিদ্বান ও সবচেয়ে অধিক ধনবান হন।


সংসারে অতুল লক্ষ্মী প্রাপ্তি তাঁর হয়,যিনি বিদ্যুৎ-এর সমান সামর্থ্যকে বাড়ান। অপ্রাপ্তকে প্রাপ্তি এবং প্রাপ্তকে রক্ষাকারী মানব ধনসম্পদ প্রাপ্ত করতে পারেন।দান দেওয়ার দ্বারা ধনসম্পদ বৃদ্ধির চর্চাও মহর্ষি বলেছেন।

পরষ্পর বিরোধ করলে ধনসম্পদের ক্ষতি হয় এবং মেলবন্ধনে মাধ্যমে পুরুষার্থ দ্বারা ধনসম্পদের উপলব্ধি হয়।সম্পত্তি সেই মানুষের  কাছেই স্থির থাকে,যিনি ধার্মিক ও উদ্যোগী হন। ধনাঢ্য বিদ্বানদের সম্মানিত করা রাজার কার্য,তবে তাঁদের সম্মান করলে নিরন্তর লক্ষ্মী বাড়ে। ধনসম্পদের বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমি ও বিদ্যুৎও,যার মাধ্যমে ব্যক্তি ধনবান হতে পারেন। ধনবান হওয়ার আরও কিছু উপায় আছে,যেমন সূর্যের সমান প্রতাপশালী,বায়ুর সমান বলবান হওয়া আর  বিদ্যা,বিদ্যার্জন,বিনয় এবং শূরবীরদের রক্ষক হওয়া ---এসব করলে ব্যক্তি শত্রুদের জয় করে কীর্তিমান হয়ে ধনবান হন।সজ্জনদের সমীপতা এবং দুর্জনদের থেকে দূরে থাকার দ্বারা ধনের বৃদ্ধি হয়।ভূগর্ভ বিদ্যার জ্ঞান মনুষ্যকে সুবর্ণাদি পদার্থ দ্বারা পরিপূর্ণ করে দেয়।



তাই মহর্ষি লিখেছেন ---


मनुष्यैः सुसाधनैः पृथिवीं खनित्वऽग्निना संयोज्य सुवर्णादोनि निर्मातव्यानि, परन्तु पू्र्व भुगर्भत्त्वविद्यां प्राप्येवं कर्तुं शक्यमिति वेदितव्यम्।। मनुष्यैर्भूगर्भाग्निविद्यया पार्थिवान् पदार्थान् सुपरीखंक्ष्य सुवर्णादीनि रान्युत्साहेन प्राप्तव्यानि। ये खनितारो भृत्या सन्ति तान् प्रति तद्विद्योपदेष्टव्या। मनुष्याः इहैश्वर्यप्राप्तये सततमुत्तिष्ठेरन्, परस्परं समत्या पृथिव्यादेः सकाशाद्रानि प्राप्तुयुः।


অগ্নি আদি পদার্থদ্বারা সম্পত্তিশালী হওয়ার কথা মহর্ষি দয়ানন্দ জি অনেক জায়গায় বলেছেন। তাঁর কথায়  খুব ভালো ভাবে জানা যায় যে, অগ্নি আদি পদার্থের দ্বারা মনুষ্য সম্পত্তিশালী হতে পারেন, যা কর্মে লক্ষ্মী প্রাপ্তি হয় । অগ্নির দ্বারা পৃথিবীতে অবস্থিত পদার্থগুলির দ্বারাও ধনপ্রাপ্তি হয়ে থাকে। বিদ্যা ও যুক্তি দ্বারা সেবন করে অগ্নি প্রচুর ধনসম্পদ তথা ধান্য প্রদান করে।বৈশ্যজন অগ্নি ইত্যাদি বিদ্যাগুলি থেকে নিজের লোকের জন্য,রাষ্ট্রজনের জন্য সমস্ত ধনসম্পত্তি সংগ্ৰহ করেন।


মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী জি ধর্মপূর্বক  ধনসম্পদ ইত্যাদি পদার্থ সঞ্চয় করে মহত্বকে প্রতিপাদিত করতে  গিয়ে বলেছেন যে,ধর্মপূর্বক ধনসম্পদ ইত্যাদি পদার্থ সঞ্চয় যারা করেন, তাঁদের অতুল ধনসম্পদ,উত্তম প্রজাদের ও সুশীল সন্তানের জন্য।যাঁরা বিদ্বান ও দৃঢ় পরিপক্কতা প্রাপ্ত করে অধ্যাপক ও উপদেষ্টা হন, তাঁরা দুঃখ দেখেন না ।যে ধার্মিক লোকেরা ধর্মাচরণ দ্বারা ধনসম্পদ উপার্জন করেন,তারা  সেভাবেই উপার্জন করবেন।অনেকে ধর্মাচারণ দ্বারা,ধনসম্পদ দ্বারা ধনসম্পদকে বাড়িয়ে প্রশংসা প্রাপ্ত করেন ‌ ।যেমন উত্তম বৈদ্য নিজের ও অন্যের শরীরকে রক্ষা করে তাঁকে বৃদ্ধি করেন, তেমনি সবাইকে ধর্মরক্ষা করে তাকে বাড়ানো উচিত, যেভাবে আমাদের  জগৎ সংসারে অনুপম সুখ হবে। হে মনুষ্য !যদি তুমি ধর্মযুক্ত ব্যবহারে লক্ষ্মী সঞ্চিত করো,তাহলে জল ও অগ্নি দ্বারা চালিত রথের সমান তুমিও সব সুখকে প্রাপ্ত করতে পারবে। যে মনুষ্য এই সংসারে বিদ্যা ও ধর্মের দ্বারকে খুলে দিয়ে পদার্থ -বিদ্যাকে সম্যক সেবন করে,এটা বাড়ায়,সে অনুপম সুখ পায়। হে বিদ্বান মনুষ্যগণ! যেমনভাবে জল সমুদ্রকে পূর্ণ করে এবং জন্তুদের রক্ষার মোতি ইত্যাদির উৎস উৎপন্ন করে, তেমনভাবে আপনারাও ধর্মদ্বারা ধনকোষকে প্রপূর্ণ করুন এবং অন্য দরিদ্রকে রক্ষা করে যশ বাড়ান।যে মনুষ্য ধর্মযুক্ত পুরুষার্থ দ্বারা ধনসম্পদ ইত্যাদি সঞ্চিত করেন, তিনি সূর্য কিরণের সমান প্রসিদ্ধ হয়ে যান।


মহর্ষি ধনেসম্পদের কারণে পরমাত্মাকে পার্থনা করে লিখেছিলেন ----হে জগদীশ্বর! আপনার কৃপা এবং অত্যন্ত পুরুষার্থ দ্বারা যেই ধন দ্বারা বহু সুখ সিদ্ধবালী সেনাবাহিনী প্রাপ্ত হয় এবং তাঁকে নিজের মধ্যে নিত্য স্থাপিত করো।

ধনের ইচ্ছা করা অপরাধ নয় । মহর্ষি এইজন্য লিখেছেন 


--मनुष्येः सदा धनाढ्यत्वमेषणीयं प्रमादो है कर्तव्यः।। ऋग् ०४.५४.१३.  ---এর ভাবার্থ।।


অর্থাৎ মনুষ্যকে সদা ধনসম্পন্নতার ইচ্ছা করা উচিৎ এবং আলস্য  করা উচিৎ নয়।




ধনসম্পদ দ্বারা সবার মঙ্গল করা মনুষ্যদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ।এই জগৎ সংসারে যে আপ্তজন ,ধর্মযুক্ত ব্যবহারে ঐশ্বর্য বাড়িয়ে তা সবার উপকার করার কার্যে খরচ করেন, এবং যেমন সত্যকে জিজ্ঞাসু লোক বিদ্বানকে যাচাই করেন, তেমন সব মানুষ নিজের ঐশ্বর্যকে উত্তম কার্যে খরচ করেন এবং বিদ্বানদের বিদ্যাকে যাচাই করেন। ধনবান লোকদের উচিৎ অন্যায়ভাবে ধনসম্পদকে না উপার্জন করে,ন্যায়ভাবে করা।ধর্ম থেকে অর্জিত ধনসম্পদ দ্বারা অনাথ পালন,বিদ্যা এবং ধর্মের বৃদ্ধি, ঔষধ বিতরণ ইত্যাদি মার্গবৃদ্ধি করে নিজের প্রশংসা সব দিকে ছড়িয়ে দেওয়া উচিৎ।এই জগৎ সংসারে যিনি ধনবান তিনি প্রেমপূর্বক নির্ধনদের  উদ্যোগ নিয়ে নিরন্তন  পালন করেন ।যিনি উত্তম ক্রিয়া দ্বারা উন্নতি করেন,তাকে ধন্যবাদ দ্বারা ও ধনসম্পদ দান দ্বারা উৎসাহিত  করুন। হে মনুষ্য! যেমন দানকারী ব্যক্তি উত্তম দান দেন  এবং পৌত্র পর্যন্ত ধন-ধান্য ,পশু ইত্যাদিকে বাড়ান, তেমনই সবার এই ব্যবহার করা উচিৎ।


ধনসম্পদ দ্বারা মনুষ্যদের সম্মানও প্রাপ্ত হয়। এইজন্য মহর্ষি লিখেছেন:----


ईश्वरस्याज्ञास्ति ये जनाः पुरुषार्थिनो भुत्वा धार्मिकाः परोपकारिणो भवन्ति,त एव पुर्णमैश्वर्यरक्षणं कृत्वा सर्वत्र सत्कृता जायन्ते।


 মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী বেদ ভাবার্থতে ধনসম্পদের সম্বন্ধে সংসারে ব্যবহৃত সুখের সাথে এটা যোগ করেছেন। তিনি অনেক মন্ত্র ভাবার্থতে ধন দ্বারা সুখপ্রাপ্তিকে চর্চা করেছেন।


এই প্রকারে লিখেছেন:----


মনুষ্যৈর্বহ্মচর্যেণ বিপয়লোলুপতাত্যাগেন ভোজজনাচ্ছাদনাদি-সুনিয়মৈশ্চ-বিদ্যাচক্রবর্ত্তি-শ্রীযোগেন সমপ্রস্যাযুপো ভোগার্থ সন্ধয়ম্।যত ঐহিকং পরমার্থিকং চ দৃঢ়ং বিশালং সুখং সদৈব বর্ধতে।ন হোতত্ কেবলমীশ্বরস্য  পার্থনয়ৈব ভবিতুমর্হতি, কিন্তু বিবিধপুরুষার্থপেক্ষং বর্ত্তত এতত্। ঈশ্বরস্যানন্দসৌভগত্যাদ্ধার্মিকস্য সভাসেনান্যায়াধিশস্য চক্রবর্তী সুখৈশ্বর্যযুক্তত্বাদেতৌ সমাশ্রিত্য মনুষষ্যৈরসঙ্খ্যাতানি বিদ্যাসুবর্ণাদিধনানি প্রাপ্য বহুসুখভোগঃ কর্তব্যঃ কারয়িতব্যশ্চেতি। যেऽত্র গোবত্ সুখপ্রদাঃ প্রাণবত্ প্রিয়াঃ প্রজাসু বর্ত্তন্তে,তেऽতুলমানন্দমাপ্নুবন্তি। যথা সূর্য আকাশে মেঘমুত্রীয় সর্বান্ সুখয়তি, তথা সত্পুরুষস্যৈশ্চর্য বর্ধমানং সত্ সকলানানন্দয়তি।যে পরমেশ্বরাদীনাং পদার্থানাং বিঞ্জানেনাऽর্হিসাদিলক্ষণে ব্যবহারে বর্ত্তিত্বা যুক্তাহারবিহারাঃ সন্ত ঐশ্বর্যমুন্নিনীষন্তি,তে সর্বতঃ সুখিনো জায়ন্তে।হে সুহৃদ ভুত্বা প্রয়েনৈশ্বর্যমিচ্ছন্তি,তৈ সুখদুঃখনিন্দাদিকং সোট্বা বিদ্বত্সঙ্গং কৃত্বাऽऽনন্দং বর্ধয়েয়ুঃ। যে ধনাদিকংপ্রাপ্যান্যেভ্যো যথাসুপাত্রং সদ্ব্যবহারং চ  বিঞ্জায় দদতি,তে সেক্তা কুম্ভমিব সর্বান পূর্ণসুখান্ কুর্বন্তি।যে সূর্যবত্রিয়মেন  ধর্মকার্যাণি সাধ্নুবন্তি,বায়ুরিব সততং প্রয়ং কুর্বন্তি, তে বদ্ধৈশ্বর্য লব্ধ্বাऽऽনন্দন্তি।যদি সত্পুরুষৈঃ সহাऽऽনকুল্যেন বর্ত্তিত্বা,পরস্পরানুভুত্যাপশুধনাদিভিরিচ্ছামলং কুর্যুস্তে সদা সুখিনঃ।স্যুঃ। মনুষ্যৈ রাঞ্জো রাজপুরুষেভ্যশ্চ ধনোত্রতিঃ,সদা কার্যা,য়েন বহুবিধং সুখং ভবেদিতি। যেসাহসেন পুরুষার্থয়ন্তো বীরসেনাং গৃহীত্বৈশ্বর্যপ্রাপ্তয়ে প্রয়তন্তে,ত এব সুখিনো ভবন্তিতি।যে মনুষ্যা ধনাদ্যৈশ্বর্যেণ ধর্মবিদ্যে উন্নয়ন্তি,ত এববহুসুখধনা ভবন্তি।বিদ্যানগ্নিনা পৃথিবীস্থপদার্থেভ্যো ধনং প্রাপ্য সুমার্গে সত্পাত্রেভ্যো দত্ত্বা বিদ্যাপ্রচারেণ সর্বান্ সুখয়েত্।



ধর্মযুক্ত ধন কোনটি?? এর উত্তরে মহর্ষি দয়ানন্দ জি লিখেছেন ,যেই ধন থেকে পুষ্টি,বিদ্যা অর্থাৎ বিদ্বানদের সৎকার,বেদবিদ্যার প্রবৃত্তি এবং সবার উপকার হয়,সেটাই ধর্মযুক্ত ধন, অন্যকিছু নয়।


ধনসম্পদযুক্ত মনুষ্যকে --শ্রীমান,ধনপতি,লক্ষ্মীবান, বল হয়।যিনি রাগদ্বেষরহিত এবং গুণকে গ্ৰহণকারী মনুষ্য হন, তিনি অন্যজনকে নিজের সমান বানিয়ে, দাতা হয়ে শ্রীমান হন।যিনি ব্রহ্মচর্য্য ও বিদ্যাদ্বারা ধর্মযুক্ত কর্ম করে,শুদ্ধ অন্তঃকরণ ও আত্মার জপ করেন, তিনি ধনপতি হতে পারেন। যে মনুষ্য অনের প্রতি নিজের মতো ব্যবহার করেন, তার সাথে নিজের সুখকে স্বীকার করতে করতে তৃপ্ত হয়ে বলিষ্ট হন, তিনি লক্ষ্মীবান হন।যে মনুষ্য উষাবেলার সমান বিদ্যার প্রকাশে অভিমুখী হন এবং সূর্যের সমান ধর্মাচারণের কামনা করে, প্রচেষ্টার সাথে ঐশ্বর্যৈর কামনা করেন, তিনি সমস্তপ্রকারে শ্রীমান হয়ে নিরন্তর বাড়তে থাকেন।হে মনুষ্য!আপনারা অগ্নি আদি পদার্থ দ্বারা দরিদ্রতা নষ্ট করে লক্ষ্মীবান হন।যে মনুষ্যগণ সূর্যোদয়ের আগে উঠেন,যতক্ষন পর্যন্ত সন্ধ্যা না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত প্রচেষ্টা করেন, তাঁরা দুঃখ ও দরিদ্রতাকে সমান  করে,সুখি ও শ্রীমান হন।বিদ্বান মনুষ্যগণদের এই সংসারে সুবুদ্ধি ও পুরুষার্থ দ্বারা শ্রীমান হয়ে, অন্যকেও ধনবান বানানো উচিত ।যিনি শীঘ্র সুখ দেন এবং বুদ্ধি বৃদ্ধিকারী পদার্থ সেবন করেন, তিনি সংসারে শ্রীসম্পন্ন হন।হে মনুষ্যগণ! তোমরা অগ্নি আদি পদার্থের বিদ্যা দ্বারা শ্রীমান হয়ে,সত্যি ভাবধারা দ্বারা অনার্থদের পালন করুন এবং দুষ্টকে তাড়িয়ে দিন।যে মনুষ্যগণ শরীর ও আত্মা দ্বারা বলিষ্ট হয়ে শাত্রার্থ বিদ্যাতে নিপুণ হয়ে উত্তম জ্ঞান ইত্যাদি সাধনা দ্বারা সম্পন্ন হয়েও পুরুষার্থ করেন, তিনি লক্ষ্মীবান হন।যে মনুষ্য ধন আদি ঐশ্বর্য দ্বারা ধর্ম ও বিদ্যার উন্নতি করেন , তিনিই খুব সুখি ও ধনবান হন।যে মনুষ্য সূর্যের সমান সব ধনসম্পদকে বাড়িয়ে,সেটাকে সুপাত্রদের দেন, তিনি ধনপতি হন। যে মনুষ্য সংসারের রচয়িতা অনাদি ঈশ্বরকে অর্থাৎ জগতের অনাদিকারণ-এর গুণ -কর্ম-স্বভাবকে জেনে উপাসনা করেন এবং উপযোগ করেন, তিনি চিরজীবী এবং ধনবান হন।যেমন বিদ্যা ও যুক্তিতে সেবন করা ধন, প্রচুর ধন তথা ধান্য প্রদান করেন, তেমনি একজন সেবাকারী পুরুষার্থী মানুষকে লক্ষ্মীবান করে তোলেন।যদি মনুষ্য আকাশের সমান চঞ্চলতা -রহিত,আনন্দদাতা,একমাত্র প্রসন্ন স্বভাবকারী,আজ্ঞার অবশ্যই পালনকর্তা এবং পুরুষার্থী হন,তাহলে আমরা সংসারে লক্ষ্মীবান কেন হবো না।

যে মনুষ্য সূর্যের সমান নিয়মপূর্বক পবিত্র হয়ে, শরীরকে নিরোগ এবং আত্মাকে  বিদ্বান বানিয়ে, পূর্ণ ব্রহ্মচর্য করে,নিজেই বরণীয় হয়ে হৃদয়ের প্রিয় স্ত্রীকে(মহিলাকে) বিবাহ করে, তাঁর  থেকে সন্তান উৎপন্ন করে ,তাকে সুশিক্ষিত করে বিদ্বান  বানান, তিনি ধনপতি হন।

মহর্ষি দয়ানন্দ জী ধন দ্বারা পরোপকার করার স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন, তবেই পরোপকারী ব্যক্তি প্রিয় হবেন।



ये धनाढ्या धनेन परोपकारं कुर्युस्ते सर्वेषां प्रिया जायन्ते।हे मनुष्याः!त एवात्र जगति परोपकाराय वर्तन्ते,ये न्यायेन द्रव्योपार्जनमाचरन्ति।


মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী ধনপ্রাপ্তি হওয়ার পরে , তার সর্বোত্তম প্রয়োগ সংসারের উপকারে লাগান।এই উপকার দ্বারা দাতার বাড়িতে ধন স্থির থাকে।---তস্যৈব কুলাদ্ধননাশো ন ভবতি,যৌऽন্যেভ্যঃ সুপুত্রেভ্যো জগদুপকারায় প্রয়চ্ছতি।হে মনুষ্যা!যঃ সত্যন্যায়েন স্বাংশং ভুক্ত্ত্বা প্রজায়াঃ সুখবর্ধনাযাऽন্যায়ং দুষ্টাংশ্চ হন্তি,স সমৃদ্ধো ভবতি।


যদিও ধন কোনোও পরিশ্রমশীল মানুষের কাছে চলে যায়, কিন্তু সেই পরিশ্রমশীল মানুষ সজন বা দুর্জন ,এর নির্ণয় তাঁর দ্বারা প্রযুক্ত ধন দ্বারাই হবে। মহর্ষি এই নির্ণয়কে এই প্রকারে বলেছেন ----सज्जनानां धनमन्येषां सुखाय दुष्टानां च दुःखाय भवति।


অর্থাৎ সজ্জনদের ধন অন্য ব্যক্তির  সুখের জন্য এবং দুষ্টের ধন অন্যজনের দুঃখ দেওয়ার জন্য হয়।

ধন অর্জন তার প্রয়োজন মাত্র স্বার্থের কারণে নিম্নস্তরের মানুষ করেন, পরোপকারের জন্য তার প্রয়োগকারী মানুষ,যেমন বায়ুর আধারের উপর স্থিত, সূর্য আদি লোক জলবর্ষা আদির দ্বারা সবাইকে আনন্দিত করেন,এমনই লক্ষ্মী অর্জিতকারী পুরুষ সবাইকে সুভূষিত করেন।

দুঃখের বিনাসের এক সাধন ঐশ্বর্য বৃদ্ধিও হয়, কিন্তু এই সাধন তখনই সফল হবে ,যখন মানুষ নিজের হাতে  পরিশ্রম করে ঐশ্বর্যৈর প্রাপ্তি করেন।

অতএব মহর্ষি লিখেছেন ---


येऽश्वैरिव साङ्गलिभिः कर्माणि कृत्पैश्चर्यमुत्रयन्ति,ते क्षीणदुःखा जायन्ते। सर्वेषां मनुष्याणामियं योग्यताऽस्ति, यथाप्राप्तस्यैश्वस्व पूरुषार्थेन प्राप्तिस्तद्रक्षत्रति क्रित्वा धार्मिकान् मनुष्यान् सङ्गैतेन सत्कृत्य च धर्ममनुष्ठाय विज्ञानमुत्रीय दुःखवन्धनान् मुक्ता भवन्तु।


ধন-সম্পদের বিষয়ে মহর্ষির চিন্তন অপার দার্শনিক এবং ব্যবহারিক। অনেক সময় মনুষ্য সংস্থান ইত্যাদির কারণে ধনী লোকের কাছে গিয়ে অপার ধন চেয়ে বসে থাকেন, কিন্তু সেখান থেকে খুব কম ধনই উপলব্ধি হয়। আবার অনেক সময় সে ধনীজনের কাছে না চাওয়ার পরও অনেক ধন উপলব্ধ হয়। সম্ভবতঃ জীবনের এই তিক্ত সত্যটি অবলোকন করে মহাত্মা বলেছেন ---বিন মাংগে মোতী মিলে,মাংগে মিলে ন ভীখ। অর্থাৎ বিনা চাওয়াতে বহুবার প্রত্যাশিত ধন অর্জিত হয় এবং চাইলে দুই রুটির যোগ্য খাবারও পাওয়া যায় না। মহর্ষিও এই লৌকিক ব্যবহার বেদে দেখে লিখেছেন ----ये धनाढ्यान् प्राप्तासङ्खान् पदार्थान् याचन्ते,ते स्वल्पं लभन्ते,ये च न याचन्ते,ते वहु प्राप्तुवन्ति।


ভাবার্থ এটাই যে লোকেরা ধনী ব্যক্তির কাছে পৌঁছে অগণিত পদার্থ চাইতে থাকেন, তাঁরা অল্প পান এবং যাঁরা কারো কাছে না চান, তিনি অনেক পান।

ধন-সম্পদের আদান-প্রদান সংসারে নিত্য চলতেই থাকে।ধনী মনুষ্যের কাছে আজ যে ধন আছে, তাঁর দান দেওয়ার দ্বারা পুনরায় তা তাঁর কাছে ফিরে আসে। প্রস্তুত মন্ত্রের ভাবার্থ এই ভাবকে প্রকট করছে----

হে ধনাঢ্য! তব প্রকাশাদ্বয়ং গবাদীন্ প্রাপ্তাऽন্যেভ্যো দদ্মঃ। অস্মাকং ধনং ভবন্তং প্রাপ্তোতু।



ঐশ্বর্যশালী মনুষ্যের জন্য মহর্ষি স্পষ্ট আদেশ দিয়েছেন যে, তাঁরা অন্যকে ধন-ধান্য ইত্যাদি দিন।


ऐश्वर्यवान्मनुष्योऽन्यभ्यो धनधान्यादिकं दद्यात्।


ধনকে বাড়ানোর এক ব্যাপার আছে,যে ব্যাপারে গাড়ি ইত্যাদি যান দ্বারা দূর দেশে গিয়ে হাজারো মানুষের সাথে সন্ধি করে করা যায়,এই প্রক্রিয়া দ্বারা মনুষ্য ধন,ধান্য এবং পশুদের অধিকারী হয়ে যান।

ये मनुष्याः शकटादियानचालनकुशला अनेकेः सहस्रैः पुरुषैः सह सन्धि कुर्वन्ति,ते धनधान्यपशुयुक्ता जायन्ते।


যাঁরা বিদ্যুতের সমান,উষাবেলার সমান এবং ঋষির সমান ধনকোষকে সঞ্চয় করেন, তাঁরা প্রতিষ্ঠিত হন।দরিদ্রতাকে যাঁরা নাশ করতে পারেন,সেই মনুষ্য শরীর কে আশ্রয় করে লক্ষ্মীর অন্বেষণ করেন। যদি মনুষ্য সেই সব  বল বাড়াতে চান,তাহলে লক্ষ্মীবান কেন হবে না । তারা সবাই লক্ষ্মীবান,যারা আলস্য ত্যাগ করে সদা শুভ কর্মের জন্য প্রচেষ্টা করেন। যেমন পশুপালক লোক পশুদের পালন করে সমৃদ্ধ হন,তেমন পুরুষার্থী দরিদ্রতা নষ্ট করে ধনপতি হন।যারা বিদ্বানদের সমান প্রচেষ্টা করতে থাকেন,তারা এই সংসারে প্রচুর লক্ষ্মীকে প্রাপ্ত করেন।


এই প্রকারে মহর্ষি  বেদভাষ্যভাবার্থতে ধন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দিশা, দরিদ্রতার বিনাশের উপায় এবং লক্ষ্মীবান তৈরির হওয়ার পথ,সরল শব্দ দ্বারা নির্দিষ্ট করেছেন।

মহর্ষি ধর্মযুক্ত পুরুষার্থ দ্বারা প্রাপ্ত ধনকেই নিজের বলে মান্যতা দিয়েছেন।অন্যায় দ্বারা প্রাপ্ত ধন নিজের নয়। জ্ঞানীদের পথকে পাখন্ডযুক্ত উপদেশ দ্বারা দূষিত না করার প্রেরণা দেন অর্থাৎ যেই রীতিতে  ধর্মযুক্ত পুরুষার্থ দ্বারা ধনপ্রাপ্ত হয়,এমনই প্রচেষ্টা করার কথা বলেছেন। তিনি ঐ সব ধনসম্পদকে সফল মানেন,যেটা ন্যায় দ্বারা উপার্জন করা হয় এবং ধর্মযুক্ত ব্যবহারে সেটার ব্যয় করা।দরিদ্রতা তার কাছে আসে না,যিনি সত্যভাবনা দ্বারা পরমেশ্বরের উপাসনা করে ন্যায়যুক্ত ব্যবহারে ধনপ্রাপ্ত করতে চান এবং যিনি সদা আপ্তজনদের সঙ্গ করেন।

অন্যায় রীতি দ্বারা ধনোপার্জন করার দ্বারা মনুষ্যের আয়ু সমাপ্ত হতে থাকে।যে মানুষ দুষ্ট আচরণ এবং দুষ্টের সঙ্গ ত্যাগ করে পরমেশ্বর ও আপ্তজনের সেবা করেন , তিনি ধনধান্যে যুক্ত হয়ে, চিরজীবী হন।

স্বয়ং ঐশ্বর্যপ্রাপ্ত করা খুবই উত্তম কিন্তু অন্যকেও ঐশ্বর্যপ্রাপ্ত করানো উত্তম থেকেও উত্তম, কিন্তু এই কার্য তিনিই করতে পারেন,যিনি স্বয়ং শোভনীয় বেশ ও আচরণে বিরাজমান থাকেন, তিনিই ঐশ্বর্যপ্রাপ্ত করে,অন্যকেও প্রাপ্ত করতে পারেন।

যখন মানুষ ধনের সংগ্ৰহ করেন,তখন সেটাকে চুরি করার জন্য চোরদের কুদৃষ্টি ওর ওপর পড়ে,সেটাকে বাঁচানোর সাধনা , মহর্ষি লিখেছেন ---যদি মনুষ্যা বায়ুবিদ্ধুতৌ সূর্যনিমিত্তে বিজ্ঞাযোপযুজ্য ধনানি সঞ্চিনুযুস্তর্হি স্তেননাশকাঃ স্যুঃ।

অর্থাৎ  যদি মনুষ্যগণ বায়ু এবং বিদ্যুৎকে সূর্যের নিমিত্ত জেনে,তার প্রয়োগ করে ধনকে সঞ্চিত করেন,তাহলে, তাঁরা চোরের  নাশকারী হতে পারেন।



অপরিমিত ধনসম্পদ সঞ্চয়কারী এবং ঐ ধন সংসারের উপকার-কর্তা সুপাত্রদের দানকারী মনুষ্যদের কেউ কোন স্পর্ধা দেখাতে পারে না, তাঁরা অজেয় হন।ঐশ্বর্যকে বাড়ানোর জন্য মানুষের সত্য আচরণ, পরমেশ্বর ও উপাসনা এবং বিদ্বানদের সংগতি খুবই প্রয়োজনীয়।সমস্ত কামনাকে মানুষ তখনই পূর্ণ করবে,যখন তিনি ধন প্রাপ্ত করে সেটা ভালো কাজে খরচ করবেন।


সংষ্কৃতভাষাতে এক প্রবাদ আছে,যার ভাবার্থ এই যে, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের সময়ে  যিনি শয়ন করেন, তিনি যদি স্বয়ং চক্রপানি ভগবান বিষ্ণুও হন,তাকে লক্ষ্মী  তাঁকে ত্যাগ করেন । মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী ঐ সন্ধ্যাবেলায় শয়ন ও আলস্য ত্যাগ করে, ঈশ্বরের ধ্যান করার নির্দেশ দিয়ে, পুরুষার্থী হয়ে সূর্য,চন্দ্রমা এবং সন্ধ্যার সমান প্রচেষ্টা করার কথা বলেছেন।যাতে প্রচুর লক্ষ্মীপ্রাপ্তি হবে----


ये पुरुषार्थिनो मनुष्याः सुर्यचन्द्रसन्ध्यावत्रियमेन प्रयतन्ते, सन्धि वेलायां शयनाऽऽलस्यादिकं विहायेश्वरस्य ध्यानं कुर्वन्ती पुष्कलां श्रियं प्राप्तुवन्ति।


 তিনি আবারও  বলেছেন ---কালের স্থুল ও সুক্ষ্ম গতিতে বিদ্বানদের সঙ্গ দ্বারা যে মনুষ্য জানতে পারেন এবং এক মূহুর্তও ব্যর্থ করেন না, তিনি বিচিত্র ঐশ্বর্যপ্রাপ্ত করতে পারেন --- 

ये मनुष्याः विद्वत्सङ्गेन कालस्य स्थुलसुक्ष्मगति विज्ञायैकक्षणमपि 

व्यर्थं न नयन्ति,ते विचित्रमैश्वर्यमाप्तुवनन्ति।


  ধনপ্রাপ্ত করার এক সাধন পূর্ণ যুবাবস্থা থেকে গৃহস্থতে প্রবেশ করাও হয়।সমাজে বাল্যবস্থায় বিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল।যার কারণে  শরীরে অনেক রোগ তথা বিধবাবিবাহ ইত্যাদি কুপ্রথার উৎপত্তি হয়েছিল । মহর্ষি এই সামাজিক কুপ্রথার বিনাশের জন্য অনেক বিদ্রোহ করেন। এমনকি নিজের বেদমন্ত্র ভাবার্থতে ঐ কুপ্রথা থেকে হওয়া অনিষ্টকর সংকেত  দিয়ে যুবাবস্থায় বিবাহের  উপকারিতা বর্ণনা করেছেন।


ये मनुष्याः पुर्णयुवावस्थां विद्याःसमाप्त सुशीलतां स्वीकृत्यातीवोत्तमाः सन्तः सुशीलाः स्रीयः स्वीकृत्य च प्रयतन्ते,ते ऐश्वर्यं प्राप्तानन्दिता भवन्ति।ये मनुष्याः सूर्यवत्रियमेन वर्तित्वा शरोरमरोगमात्मानं विद्वांसः संसाध्य पुर्ण ब्रह्मचर्यं  कृत्वा स्वयं वृतां हृद्याः स्रियं स्वीकृत्य तत्र प्रजा उत्पाद्य सुशिक्ष्य विदुषीः कुर्वन्ति,ते स्रीयः पतयो जायन्ते।


অর্থাৎ যে মনুষ্য পূর্ণ যুবাবস্থায় বিদ্যা প্রাপ্ত করে আর সুশীলতা অবলম্বন করে অত্যন্ত উত্তম হয়ে সুশীল স্ত্রীর সাথে বিবাহ করার প্রচেষ্টা করে, তিনি ঐশ্বর্যপ্রাপ্ত করে আনন্দিত হন। যে মনুষ্য সূর্যের সমান নিয়মপূর্বক প্রবৃত্ত থেকে, শরীরকে নিরোগ ও আত্মাকে বিদ্বান বানিয়ে, পূর্ণ ব্রহ্মচর্য করে নিজেই বরণীয় হয়ে হৃদয়ের প্রিয় স্ত্রীকে বিবাহ করেন এবং তাঁকে সুশিক্ষিত করে বিদ্বান বানান, তিনি ধনপতি হন।



মহর্ষির দৃষ্টিতে বর্তমান সময়ে  যথার্থ পুরুষার্থকারী মনুষ্য ধনপতি হন, কিন্তু ধনপতি হওয়ার পরও বিদ্বানদের সঙ্গ না করলে, তিনি ধনহীন হয়ে দরিদ্রতায় ভুগতে থাকেন ----


ये वर्तमान समये यथार्थं पुरुषार्थ कुर्वन्ति ते धनपतयो भवन्ति,ये च विद्वत्सङ्ग न कुर्वन्ति,धनहीनाः सन्तो दारिद्र्यं भजन्ते।


ধনকে স্থির রাখার উপায় মহর্ষি  বিদ্বানদের দ্বারা সদ্গুনের জিজ্ঞাসা করতে তিনি লেখেন ---हे मनुष्याः विद्वद्भ्यः सद्गुणान् भवन्तो याचेरंस्तर्हि स्वयं प्रज्ञा धनाढ्या भवेयुः।।


ধনসম্পদের সাথে সাথেই মহর্ষি অনেক ঐশ্বর্য শব্দের প্রয়োগও করেছেন। ধন‌ তথা ঐশ্বর্যের সামান্য  ব্যবধান পূর্বেই মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী জি তার শব্দে দেখিয়েছেন। তিনি এই ঐশ্বর্যের প্রাপ্তি ও বৃদ্ধির কারণও নিরন্তর পুরুষার্থ হওয়া মানেন।


তিনি লিখেছেন----नहि प्रतिदिनं सततं पुरुषार्थेन विना मनुष्याणामैश्वर्यप्राप्तिजायते तस्मादेव तैर्जितं प्रयतितव्यं यत ऐश्वर्यं वर्धते। सर्वेः पुरुषार्थेन विद्वत्प्रज्ञां प्राप्त महादैश्वर्य सञ़्चेतव्यम्। ये पुरुषार्थिनो जना दस्य्वादीन् दुष्ढाम् निवार्य श्रेष्ठान रक्षने सन्दध्यस्ते जगत्यैश्वर्य लभन्ते।य इह सर्वेषां वलपराक्रमवर्धकाः   साधनोपसाधयुक्ताः  पृथक मिलित्वा वा प्रयतन्ते, तेऽत्राद्यैश्वर्ययुक्ता भवन्ति।ये धनवस्तर्ववर्धकाः सन्ति,ते परमेश्वर्य लव्ध्या प्रयतन्ते। त एव श्रोकरा जना भवन्ति,य आलस्यं त्याजयित्वा पूरुषार्थेन सह योजयन्ति। ये ब्रह्मचर्यंमाचरन्ति,तेषामैश्वर्यप्रापकमं सामर्थ जायते।येऽन्योन्यस्य रक्षां विदघाति,ते सदा सुखिनो भवन्तोति। मनुष्यैः श्रीप्राप्तय उद्योगः सदैव कर्तव्यो यथा विद्वांसो धनलक्ष्मये प्रयतेरंस्तद्वदनुप्रयतितव्यम्।ये पुरुषार्थेन महदैश्वर्य प्राप्त धनं सुरक्ष्याऽऽनन्द भुञ्जते, ते सदैव वर्द्धते।यदि मनुष्या ऐश्वर्यंव्रधनाय प्रयतेरंस्तर्हि सत्यं परमात्मनं विदुपश्च सेवेरन्।य उत्साहेनैश्वर्यमुत्रेतुमिच्छन्ति,ते सकलैश्वर्यै प्राप्त सर्वत्र सत्कृता ये चालसास्ते दरिद्रत्वेनाऽभिभूताः सदा निरस्कृता भवन्ति।


পরিশেষে মহর্ষি, পুরুষার্থ দ্বারা ঐশ্বর্যপ্রাপ্ত করার আদেশ দিতে গিয়ে লিখেছেন----मनुष्यैर्यथा युक्ताः पुरुषाः सर्वेश्वर्यनाप्नुवन्ति ,तथैव वयं सर्वानन्दं प्राप्नुयामेतीच्छा कार्या।


অর্থাৎ মনুষ্যকে পুরুষার্থে নিযুক্ত থাকাকালীন সময়ে সমস্ত ঐশ্বর্যপ্রাপ্ত করতে হবে, এভাবেই মনুষ্যের সম্পূর্ণ আনন্দকে প্রাপ্ত করার ইচ্ছা করা উচিৎ ।

 ঐশ্বর্যপ্রাপ্তির কিছু উপায়ের চর্চা মহর্ষি দয়ানন্দ বিভিন্ন  বেদমন্ত্র ভাবার্থতে বলেছেন যে, যাঁরা শত্রুদের জয় করেন, অতিথিদের সৎকার করেন, ধার্মিকদের বিদ্বান প্রদান করেন, তাঁরা সূর্যের মতো মেঘের মতো সম্পূর্ণ ঐশ্বর্যের ধারণ করেন।যেমন বায়ু ও বিদ্যুৎ সব জায়গায় ব্যাপক হয়ে সব বস্তুর সাথে সম্পর্ক করে, তেমনই ঐশ্বর্যপ্রাপ্তির জন্য সব সাধন প্রচেষ্টা করা উচিৎ। যাঁরা সূর্য ও বায়ুর সমান সবার উপকার করেন, তাঁরা লক্ষ্মীসম্পন্ন হন।যে বিদ্বান লোক সবার মিত্র হয়ে অনেক জনের সাথে উন্নত ভোজন করেন এবং বিদ্বানবৃদ্ধ পণ্ডিতদের সাথে  যোগাযোগ করেন, তিনি সমর্থ ও ঐশ্বর্যবান হন। যাঁর অধিকারে সমস্ত বিদ্যা এবং যিনি উৎপন্ন হওয়া শত্রুকে মারেন , তিনিই দিব্য ঐশ্বর্যপ্রাপ্তিকারী হন।যাঁরা বল চান ,দুষ্টকে তাড়িয়ে ধর্মাত্মাদের সুখী করেন এবং সবসময় সবার উন্নতি চান, তাঁরাই অগণিত ঐশ্বর্য-প্রাপ্ত করেন।যে মনুষ্যগণ সুখের জন্য বহু সাধন সংগৃহীত করেন, তাঁরা ঐশ্বর্য পেয়ে প্রসন্ন থাকেন। যে  বিদ্বান এই বিবিধ আকৃতিযুক্ত এই জগৎ সংসারের কারণকে জানতে পারেন এবং এই বিশ্বের নির্মানকর্তা পরমাত্মার প্রশংসা করেন, তিনি ঐশ্বর্যসম্পন্ন হন।




যিনি ঐশ্বর্য চান, তিনি অবশ্যই বল ও বুদ্ধিকে বাড়ান।হে মনুষ্য! বিদ্বানদের দ্বারা রক্ষিত এবং প্রবুদ্ধকারী তোমরা ,লক্ষ্মীকে তথা উত্তম মনুষ্যদের সাহায্য দ্বারা সমস্ত ঐশ্বর্যের প্রাপ্তি করো ; হে বিদ্বানগণ! তোমরা শরীর ও আত্মার পুষ্টিকারী পদার্থকে জানো এবং তার প্রয়োগ করে ঐশ্বর্য প্রাপ্ত করো।যাঁরা বিদ্বানদের ধন প্রদান করেন ও যার রক্ষা আপ্তজন করেন,তাঁরা সদা সুরক্ষিত হয়ে বাড়তে থাকা সম্পূর্ণ ঐশ্বর্যশালী হয়ে যান।যাঁরা পূর্ণ বিদ্বানদের সাথে কর্ম, উপাসনা ও জ্ঞানের বিদ্যা ও উত্তম ক্রিয়াকে গ্ৰহণ করে তার সেবন করেন , তাঁরা সবদিক থেকে সুরক্ষিত হয়ে মহান ঐশ্বর্য প্রাপ্ত করেন। ঐশ্বর্য কামনাকারী মনুষ্যদের কখনও বিদ্বানদের সেবা এবং সংগতিকে ত্যাগ করে এবং শত্রুদের যথোচিত বিজ্ঞান ও সেবন ছাড়তে বলা কখনোই উচিৎ নয় ।


এই প্রকারে মহর্ষি ঐশ্বর্যপ্রাপ্তি হেতু শত্রুবিজয়, অতিথি সৎকার,বিদ্যাদান, সাধনার প্রয়োগ, উপকার,মিত্রতা,বৃদ্ধ বিদ্বানদের থেকে চর্চা,প্রকৃতিবিজ্ঞান, পরমেশ্বর -প্রশংসা,ধনদান,ঋতুজ্ঞান এবং বিজ্ঞান  দেখিয়েছেন।ঐশ্বর্যের প্রাপ্তিতে এ সবেরই কোনো না কোনো কারণ  অবশ্যই আছে।


মহর্ষি ধনসম্পদের স্থানে  কোথাও কোথাও শ্রী শব্দের প্রয়োগও করেছেন।এই শ্রী শব্দের প্রাপ্তির কারণ দেখাতে গিয়ে উনি লিখেছেন ----


हे मनुष्याः! व्यावद्युष्माकं वृढाङ्गानि शरीराणि पवित्राः प्रज्ञाः धर्मात्मानामाप्तानां विदुषां सङ्गो जितेन्द्रियत्वेन पूर्णमायुर्न भवति,तावदतुलाः श्रियो विद्याश्च न भवन्तिति वेद्यम्।ये मनुष्या धनेन सैन्यं श्रेष्ठतां प्रजामारोग्यं वलं च वर्धयन्ति,ते सर्वदाऽग्रश्रियो भवन्ति।


অর্থাৎ হে মনুষ্যগণ! যতক্ষন তোমার দৃঢ় অঙ্গযুক্ত শরীর, পবিত্র বুদ্ধি,ধর্মাত্মা আপ্ত বিদ্বানদের সঙ্গ এবং জিতেন্দ্রিয়তার দ্বারা পূর্ণ আয়ু না হয়, ততক্ষণ অতুল  শ্রী ও বিদ্যা হবেনা,এটা জানা উচিৎ। যে মনুষ্য ধন দ্বারা সেনা,শ্রেষ্ঠতা,প্রজা , স্বাস্থ্য এবং বল বাড়ান, তিনি সর্বদা নবীন নবীন শ্রীযুক্ত হন।

এ প্রকারে তিনি অন্যত্রও লিখেছেন ---पूर्णा श्रियं कुर्वन्ति तथात्मानं पुरुषः परमेश्वरे भुराज्ये च सुप्रकाशते।


পরিশেষে মহর্ষির এই আশির্বাদাত্মক কথাগুলি আমি তুলে ধরতে চাই ----


ये पुर्जविद्यावामौ विद्वांसावाश्रयन्ति,ते धनधान्यैश्वर्यैः पुर्णा जायन्ते।ये धनमाप्नुयुस्ते परेषां सत्कारं कुर्युः।ये क्रियाकुशलाः शिल्पिन ऐश्वर्यंमाप्नुयुस्ते सर्वैः सत्कर्त्तव्याः स्युः।


অর্থাৎ যে লোক পূর্ণ জ্ঞানের সাথে দুজন আপ্ত বিদ্বানদের আশ্রয় লাভ করেন, তিনি ধন-ধান্য ইত্যাদি ঐশ্বর্য দ্বারা পূর্ণ হয়ে যান। যিনি ধন পাবেন ,তিনি অন্যকে সৎকার করবেন। যেসব ক্রিয়াতে নিযুক্ত শিল্পী লোক ঐশ্বর্য প্রাপ্ত করেন, তাঁরা সবদিক থেকে সম্মাননীয় হবেন।




এইভাবে আমরা দেখতে পাই যে , কোষাধ্যক্ষগণ অর্থ শব্দটিকে, এর  বিভিন্ন প্রতিশব্দ দিয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন, মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী সেই অর্থকে ধর্মীয়ভাবে উপার্জন করার সাথে সাথে পরোপকারে বিনিয়োগের নির্দেশ দিয়েছেন।  তিনি ধন ও ঐশ্বর্যের মধ্যে যৎকিঞ্চিৎ পার্থক্য মেনেছেন।ধনপ্রাপ্তি হেতু তিনি অনেক উপায়-এর সাথে পুরুষার্থ এবং ধর্মকে মূখ্য মেনেছেন। লোকমুখে প্রচলিত বিভিন্ন কিংবদন্তিরা তাকে বেদ ভাবার্থতে সরল শব্দের মধ্যে দেখেছেন।ধন দ্বারা তৈরি সম্মান,প্রতিষ্ঠা,যশ, স্বাস্থ্য, ইত্যাদি বিভিন্ন স্থানে বর্ণিত হয়েছে । মনুষ্য ধন হতেই শ্রীমান,ধনপতি এবং লক্ষ্মীবান বলাতেই শোভা পান। পরোপকার হেতু নির্মিত সংস্থানগুলিতে ধনদানের আদেশ দিয়েছেন।ধনপ্রাপ্ত হয়ে যায় কিন্তু তা কিভাবে স্থির থাকবে সেই বিষয়ে মহর্ষির মন্তব্য ধনী পুরুষদের জন্য অবশ্যই অনুকরনীয়। এই ধনকে চর্চা করতে তিনি সমাজে পূর্ণ যুবাবস্থা থেকে বিবাহিত হওয়ার এমন নির্দেশ দিয়েছেন যাতে ধন পুরোপুরি বাড়তে থাকে।এই প্রকার ধন তথা ‌তার প্রয়োগের বিষয়ে মহর্ষি দয়ানন্দ -এর বিচার সমাজে নতুন চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিল।



দয়ানন্দ বিচারধারার আলোকে অথর্ববেদের মনিসূক্তার সরসতা


ডাঃ দিনেশচন্দ্র শাস্ত্রী


কৌশিক সূত্র,নৈদানসূত্র,নক্ষত্রকল্প, অথর্বপরিশিষ্ট এবং সম্বন্ধিত অনুক্রমণিকাকে অনুগমন করে কর্মকাণ্ড বিনিয়োগ ভাষ্যকারী আচার্য সায়ণ ইত্যাদি অথর্ববেদের কোনো প্রকরণকে উভয় যাদুর বাক্স  বানিয়ে দিয়েছেন। বেদের অপ্রতিম ভাষ্যকার স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী, ঈশ্বরীয় জ্ঞান বেদকে ,দূষিতকারী এই প্রকার কুৎসিত কথাগুলির তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন।তাঁর বেদভাষ্য ও বেদ সম্বন্ধিত সৎসাহিত্য দ্বারা সঠিক  আর্য দৃষ্টি ও অনুপ্রেরণা পাওয়ার পর, অনুসারী অনেক বেদভাষ্যকারীগণ,যেমন পণ্ডিত ক্ষেমকরণদাস ত্রিবেদী,পণ্ডিত উপদেব শর্মা বিদ্যালঙ্কার,পণ্ডিত বুদ্ধদেব বিদ্যালঙ্কার,  প্রফেসর  বিশ্বনাথ বেদোপাধ্যায় এবং স্বামী সত্যপ্রকাশ সরস্বতী ইত্যাদি , নিজের নিজের অথর্বভাষ্যতে এটা দেখানোর প্রয়াস করেছেন যে,এইসব কথা বেদে লেখা নেই ,পরন্তু দোষ  দেওয়া হয়েছে। এখানে অথর্ববেদের কিছু সূক্ত ও মন্ত্রের  উপর স্বামী দয়ানন্দের বিচারধারার আলোকে লিখিত ভাষা-ভাষ্যের অনুসারে বিচার করে এটা দেখানোর প্রয়াস করবো যে কিভাবে এই সব কথা বেদের (স্বারস্য) বিপরীত হয়।


অথর্ববেদের সৌনক- সংহিতাতে এমন অনেক সূক্ত আছে,যেগুলিকে মণিসূক্তা বলা হয়।যেমন---


১| অভিবর্তমণি অথর্ব। ১.২৯

 ২| জঙ্গিডমণি অথর্ব।২.৪.১৯.৩৫

৩| পর্ণমণি অথর্ব।৩.৫

৪| অশ্বত্থমণি অথর্ব।৩.৬

৫| শঙ্খমণি অথর্ব।৪.১০

৬| প্রতিসরমণি অথর্ব।৮.৫

৭| বৈয়াঘ্রমণি অথর্ব।৮.৭

৮|  বরণমণি অথর্ব।১০.৩

৯| ফালমণি অথর্ব।১০.৬

১০| দর্ভমণি অথর্ব।১৯.২৮-৩০.৩২-৩৩

১১| ঔদুম্বরমণি অথর্ব।১৯.৩১

১২| শতবারমণি অথর্ব।১৯.৩৬


১৩| অমৃতমণি অথর্ব।১৯.৪৩


সায়ণাদি বৈণিয়ৌগিক ভাষ্যকারদের অনুসারে উপর্যুক্ত মণিসূক্ততে বর্ণিত পদার্থগুলিকে ঐ সূক্তে বর্ণিত মন্ত্রপাঠ পূর্বক ছোট ছোট খন্ডরূপে শরীরকে কোনো অঙ্গের সাথে বেঁধে অথবা কোনো অন্যপ্রকার প্রয়োগে নিয়ে ,অভিষ্ট ফল প্রাপ্তির জন্য অথবা অনিষ্টের নিবারণের জন্য যাদু বিদ্যার রূপে প্রযুক্ত করেন।এই ক্রিয়াকলাপ থেকে অন্ধবিশ্বাসের জন্ম দেয়। এইসব 'মণি' শব্দের অর্থকে সঠিকভাবে না বুঝলে এবং মন্ত্রের অর্থকে ঠিকমতো বুঝতে না পারার কারণে এসব করা হয়। ভালোভাবে লক্ষ্য করলে এরকম  মন্ত্রের অন্য অর্থ সামনে আসে।



'মণি' শব্দ এবং 'রত্ন' শব্দটি যেকোন অত্যন্ত  উপযোগী এবং মূল্যবান বস্তুকে বলা হয়। এই অর্থে অথর্ববেদে 'মণি' শব্দের প্রয়োগ রয়েছে। এইজন্য চলতি ভাষায় পুরুষের বীর্যকেও মণি বলা হয়,কারণ স্বাস্থ্য ইত্যাদির দশা  এবং বংশবৃদ্ধির জন্য বীর্য থেকে বড়ো আর কোনো উপযোগী ও শ্রেষ্ঠ বস্তু নেই।ব্যবহারিক  ভাষাতে এই কারণে , কোনো প্রতিষ্ঠিত পন্ডিত বা মহান কবি ইত্যাদিকে  কবি শিরোমণি,কবিরত্ন এবং পন্ডিত শিরোমণি ও পন্ডিতরত্ন ইত্যাদি শব্দ দ্বারা সম্মানিত করা হয়।।এই মণিসূক্তোতে  যেই পদার্থের বর্ণন আছে,সেই পদার্থ নিজ প্রয়োজন পূরণ করার দৃষ্টি থেকে অত্যন্ত উপযোগী এবং মূল্যবান হয়, এইজন্য ওটাকে 'মণি' বলা হয়। মন্ত্রতে কোথাও কোথাও 'মণি' দ্বারা বাঁধার উল্লেখও আছে।মন্ত্রতে এই কথার ভাবাধারাতে সেটাকে তাবিজের ভ্রান্ত বাঁধন ভাবা উচিৎ নয়।এই ভুলভ্রান্তি নিজের বশে করে,তার থেকে উপযোগী হয়ে,তার সেবন করা ইত্যাদি ভাবধারা নেওয়া উচিৎ। কেননা বন্ধন কেবল সূতো ইত্যাদির দ্বারা হয় না। 


যোগদর্শনে ,'देशवन्धः चित्रस्य धारणा'-- সূত্রতে নাসিকাগ্ৰ দ্বারা চিত্রকে বাঁধার কথাও আছে।ধারণা  হল যোগাঙ্গ।এই প্রকার মণিসূক্ততে वध्नामि,वध्नात् ইত্যাদি পদ যথাযথভাবে দেওয়া উচিৎ । অথর্ববেদীয় মণিসুক্ত কাব্যময়ী আলংকারিক ভাষাতে লেখা আছে এবং ঐ রূপে এই মন্ত্রকে বাঁধা ইত্যাদি শব্দকে লোক প্রসিদ্ধ  সাধারণ অর্থ না করে, তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যার্থ  দেখা উচিৎ।পন্ডিত শ্রীপাদ দামোদর  সাতবলেকর, এই সূতো,তাবিজ ইত্যাদিকে যাদুটোনের রূপ দিয়ে বেঁধে কেবল বিশ্বাসের বীজ মেনে লিখেছেন ----

'यह केवल भावना कि कल्पना '।


ডাঃ কপিল দেব ত্রিবেদীর মতানুসারে, অথর্ববেদের এই মণির পিছনে এই ভাবনা লুকিয়ে আছে যে,প্রত্যেক বৃক্ষতে কিছু গুণ আছে।এই গুণ তার শাখা এবং পত্রাদিতেও হয়।ঐ বৃক্ষের ফল ইত্যাদি সেবন দ্বারা যা লাভ প্রাপ্ত হয় ,তা তার শাখা কাছে রাখার দ্বারাও প্রাপ্ত হতে পারে। এইজন্য বিশেষ বৃক্ষকে  মন বানিয়ে তাকে শরীরের উপর বেঁধে নেয় বা গলায় ঝুলিয়ে নেয়। বিশেষ বৃক্ষতে থাকা সব গুণ তার মনকে বা মণি দ্বারাও প্রাপ্ত হতে পারে। 'পুনর্নবা' নামক ঔষধিকে ছোট ছোট মনকে বানিয়ে সেই মালা গলাতে এমনভাবে পরতে হবে ,যাতে শরীর স্পর্শ করে থাকে,তাহলে পোলিও রোগে এই ঔষধির প্রভাব সিদ্ধ হয়।এটা তো আমাদের অনুভূত প্রয়োগ।এইভাবে মণিসূক্তোক্ত ঐষধিগুলির আয়ুর্বেদিক প্রয়োগ বিভিন্নভাবে অথর্ববেদে ইঙ্গিত হয়েছে।



উক্ত ভাষা-ভাষ্যগুলির অনুসারে উপর্যুক্ত মণিসূক্তগুলিকে আমরা দুটি ভাগে বিভক্ত করতে পারি----

১|আয়ুর্বেদপরক 

২|রাজনীতিপরক


নিম্নলিখিত রূপে সেগুলির এক এক প্রকার প্রদর্শিত কতরে পারি----আয়ুর্বেদ (ঔষধি)পরক মণিসূক্ত, রাজনীতিপরক মণিসুক্ত।


১|জঙ্গিডমণি অথর্ব ২.৪১.পর্ণমণি অথর্ব ৩.৫


২| শঙ্খমণি অথর্ব ৪.১০২.প্রতিসরমণি অথর্ব ৮.৫


৩| শতবারমণি অথর্ব ১৯.৩৬৩.অভিবর্তমণি অথর্ব ১.২৯

 

৪| বৈয়াঘ্রমণি অথর্ব ৮.৭.১৪৪ অস্তৃতমণি অথর্ব ১৯.৪৬


৫|  অশ্বত্থমণি অথর্ব ৩.৬৫. দর্ভমণি অথর্ব ১৯.২৮-৩০.৩২-৩৩

৬| ঔদুম্বরমণি অথর্ব ১৯.৩১


উপর্যুক্ত মণিসূক্তোর দ্বারা 'বরণ','কাল' ,'জঙ্গিড' এবং 'অশ্বত্থ' মণিগুলির নানারকম ব্যাক্ষা হতে পারে। এইভাবে আমাদের অধ্যয়ন দ্বারা জ্ঞান  হয়। আচার্য প্রিয়ব্রত বেদ বাচস্পতিতে নিজের গ্ৰন্থ বেদ এবং এর বৈজ্ঞানিকতা পৃষ্ঠা ৩৬৬ তে লিখেছেন যে গম্ভীর অধ্যয়ন,মনন,চিন্তন, অনুসন্ধান করার পর আয়ুর্বেদের গ্ৰন্ত্র দ্বারা সহায়তা নেওয়ার পরে, প্রায় সব মণিসূক্তের কোনো না কোনো ঔষধিগুণের সুন্দর ব্যাক্ষা থাকতে পারে,এই কথা  সত্য বলে বিবেচিত হবে না। কেননা  আর্য ভাষা-ভাষ্যগুলির অনুসারে উপর্যুক্ত ১৩ মণিসূক্তোর দ্বারা অর্ধেকের বেশি রাজনীতিপরখ ব্যাক্ষা  রয়েছে।তাহলে আচার্য প্রিয়ব্রতের কথা কিভাবে মানা যেতে পারে? উপর্যুক্ত দুটি বর্গে বিভক্ত মণিসূক্তের সরসতা এই প্রকার ------


(ক) আয়ুর্বেদপরক মণিসূক্ত---


১| জঙ্গিডমণি---এই মণির বর্ণন অথর্ববেদের ২.৪ আর ১৯.৩৪-৩৫ এই তিন সূক্ততে প্রাপ্ত হয়। অথর্ব ২.৪ সূক্তে ভাষ্যের উত্থানিকার জঙ্গিডমণির মহিমা বলতে , আচার্য সায়ণ লিখেছেন, যে ব্যক্তি হিংসা থেকে বাঁচতে চায়, নিজেকে রক্ষা করতে চায় এবং বিঘ্নের শান্তি চায়, সেই জঙ্গিত গাছ দ্বারা বানানো বিশেষ প্রকারের মণির শনের সূতো দিয়ে পিরোকর মণি বাঁধার বিধি দ্বারা এই সূক্তের মন্ত্র পড়ে বাঁধতে।

জঙ্গিড কোন এই প্রকার মণি নয়,যেই সূক্তের মন্ত্র পড়ে বাঁধার দ্বারা এই যাদুটোনের রূপে হিংসা ইত্যাদি বিপত্তিগুলির থেকে কাউকে রক্ষা করা সম্ভব। এটা এক প্রকারের ঔষধিই। অথর্ব ১৯.৩৪.৯ মন্ত্রে জঙ্গিতকে ভূমির উপর উৎপন্ন হওয়া বনষ্পতি বলা হয়। অথর্ব ১৯..৩৪.৯ মন্ত্রে ,এটাকে রাগ নিবারণকারী ঔষধি বলা হয় আর অথর্ব ১৯.৩৫.১ -মন্ত্রে, এটাকে ভেষজ অর্থাৎ রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ঔষধি বলা হয়। এবং অথর্ব ২.৪.৩ আর ১৯.৩৫.৪ মন্ত্রে এটাকে বিশ্বভেষজ অর্থাৎ অনেক প্রকার রোগের নিবারণকারী ঔষধি বলা হয়েছে। অথর্ব ২.৪.৫ মন্ত্রে বলা আছে যে,জঙ্গিতের সাথে শন(সন) নামক ঔষধির প্রয়োগ করার দ্বারা বিশেষ লাভ হয়।জঙ্গিত ঔষধি জঙ্গলে প্রাপ্ত হয় এবং সন ক্ষেতে প্রাপ্ত হয়। এই ঔষধি রোগ-বাধাকে শিথিল করে গতিশূন্য অঙ্গকে গতি প্রদান করে। কোনো রোগ বা ক্ষত ইত্যাদির কারণে শরীরের কোনো স্থানের মাংস পচে গলে গেলে,এই ঔষধি ওটাকে ঠিক করতে পারে।




এই মন্ত্রতে এই ঔষধিকে সহস্রবীর্য অর্থাৎ বড়ো ,ভারী গুণযুক্ত শক্তিশালীও বলা হয়েছে।এই ঔষধি , কারো দ্বারা শরীর কেটে গেলে  , তৈরি হওয়া ক্ষত (কৃত্যা) ঠিক করে দেয়।এই ঔষধির প্রয়োগ দ্বারা কাঁধের শক্ত হওয়া রোগও (সংস্কন্ধ) নিরাময় করা যায়।এই ওষুধটি সব প্রকার রোগকে (অমীবা) নিরাময় করতে পারে। এই ঔষধি বলের ক্ষীণতা (বলাস),পিঠের রোগ (পৃষ্ঠঘাময়) আর কষ্টদায়ক জ্বর (তক্মা) ইত্যাদিকেও প্রশমিত করার শক্তি রাখে।এই সূক্ততে যে অরাতি অর্থাৎ শত্রুদের মারার কথা বলা আছে আর যে রাক্ষসকে মারার কথা বলা আছে,তার তাৎপর্য রোগজনক কৃমিরূপ  শত্রুদেরকে  বোঝা উচিৎ।

অথর্ববেদের  মধ্যে জঙ্গিডমণির যে গুণ মানা হয়েছে, তা রাজনিঘন্টুতেও সেই গুণ 'वच' -এর উল্লেখ আছে। অতএব বিদ্বানগণ জঙ্গিড দ্বারা 'वचा'-র অভিপ্রায় লিখেছিলেন। পন্ডিত দামোদর সাতবলেকর, 'अथर्ववेद का सुवोध भाष्य ' প্রথম ভাগ পৃষ্ঠা ৩২ -তে 'বচা' ও 'জঙ্গিড' এর তুলনা এইপ্রকারে করেছেন ---


'বচা'র গুণ---


বৈদিকগ্ৰন্থের শব্দ~

১| আয়ুষ্যা

২|রক্ষোঘ্নী বা ভুতঘ্নী

৩| বাতঘ্নী বা উন্মাদঘ্নী

৪| মংগল্যা,ভদ্রা,স্মতিবর্ধিনী

৫| বিজয়া

৬| অতিসারঘ্নী

৭|শৌফঘ্নী,জ্বরঘ্নী


এই সুক্তের (২.৪) শব্দ


১| দীর্ঘযুত্বায় (মন্ত্র ২) আংযূষি তারিষত্ (মন্ত্র ৩),

২| রক্ষাংসি সহামহে (মন্ত্র ৪),

৩| জম্ভাত পাতু (মন্ত্র ২) অভিশোচনাত্ পাতু (মন্ত্র ২),

৪| অরিষ্যন্তঃ ( মন্ত্র ২) দক্ষমণাঃ।সহস্রবীর্য (মন্ত্র ২ ),

৫| অরাতিদূষিঃ( মন্ত্র ৬),

৬| বিশরাত্ (বি-সারাত্) পাতু (মন্ত্র ২)

৭| বিশ্বভেষজঃ (মন্ত্র ৩) কফহনী,গ্ৰংথিহনী


পন্ডিত দামোদর সাতবলেকর ও নিজে 'অথর্ববেদের সুবোধ ভাষ্য'- প্রথমভাগে জঙ্গিডকে ঔষধি মানতে জোরদার শব্দে যাদু-বিদ্যার খন্ডন করতে গিয়ে লিখেছেন ---

এই ২.৪সূক্তে যে জঙ্গিডমণির বর্ণনা আছে,তা তাবিজ বা সূতো ডোরা বা যাদুর ব্যাপার নয়।।এটা বাস্তবিকই ঔষধ। এর পূর্বে তৃতীয় সূক্তে পর্বত ও পৃথ্বীর উপরে অবস্থিত  আর সমুদ্রতলে উৎপন্ন হওয়া বনষ্পতির বর্ণনা এসেছে,এই ঔষধি বনস্পতি গুলির অনুসরণই এই সূক্তে আছে।এই দুটি সূক্ত একসাথে   এবং এই দুটিই রোগ নিরাময় এবং আরোগ্য সাধন উভয়ের মধ্যে সমান। এইজন্য এই ঐষধিতে মণির কথা স্পষ্ট।


আজকাল যে তাবিজ,কবচ,ধাগা,ডোরা যাদুর পদার্থ,যা কেবল বিশ্বাস বা ভাবনা দ্বারা তারই কল্পনার জিনিস ।জঙ্গিমণি এমন নয়। এর ঔষধির সম্বন্ধে বিশেষ রীতি দ্বারা শরীরের সাথে যুক্ত হয়।যদিও শরীরের অন্দরে এই ওষুধের সেবন হয়না, কিন্তু  শরীরের উপর স্পর্শ দ্বারা লাভ হয়।......জঙ্গিডমণি স্পর্শজন্য দোষের দূরীকরণের কারণ,যদি এটা শরীরে ধারণ করা যায়,তাহলে তার রোগ দূর হওয়ার শঙ্কা হতেই পারে না।এই সূক্তে দূষণ,দূষি শব্দগুলি অন্য অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে । যেমন


१| निष्कन्ध दूषण-निष्कन्ध को विगारने वाला

२| कृत्वादूषि-कृत्या को दोष लगाने वाला

३| अरातिदूषि-अराति को दोष लगाने वाला


 সূক্ষ্মদৃষ্টি দ্বারা দেখার পর এই শব্দ প্রয়োগে এটাই স্পষ্ট  যে,শত্রুর মধ্যে 'দোষ সৃষ্টি করা' -এটা সূচিত হয়েছে।কেউ বলেন শত্রুকে মারো,কাটো,শত্রুকে নাশ করো।বেদে শত্রুকে নাশ করার কথা অনেক বার বলা হয়েছে।কিন্তু সেখানে অন্যকে উপদেশ, শত্রুকে দূর করার বিষয়ে হয়েছে।শত্রুর মধ্যে দোষ উৎপন্ন করা,শত্রুর মধ্যে  হীনতা উৎপন্ন করা,শত্রুর কার্যকারীতে দোষ উৎপন্ন করা।যেই সময় শত্রুর শীঘ্র নাশ না হয়,সেই সময় অনেক উপায় দ্বারা শত্রুর অন্দরে দোষগুলিকে বাড়ানোর দ্বারা,শত্রুর বল হ্রাস পায় এবং আমাদের নিজেদের বল বৃদ্ধি পায়।এটি যেমন ব্যক্তিগত রোগের ক্ষেত্রে সত্য, তেমনি সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় শত্রুদের বিষয়েও সত্য,শত্রুর মধ্যে দোষ উৎপন্ন করার দ্বারা সামান্য প্রচেষ্টায় শত্রুকে পরাজিত করা যায় এবং নিজের জন্য বিজয় প্রাপ্তি হয়।


পন্ডিত সাতবলেকর-এর মতে, মণির ধারণ দ্বারা যেমন শরীরের রোগগুলো শত্রুদের শক্তির  মধ্যে দোষ উৎপন্ন করে, তার শক্তি ক্ষীণ হয়ে যায় এবং নিজের বল বাড়তে থাকে, তেমনই রাষ্ট্ররূপী শরীরের ক্ষেত্রের মধ্যেও এই মণি দ্বারা রাজনীতির রাষ্ট্রদমন বিষয়ক এক বড়ো সিদ্ধান্তের জ্ঞান হতে পারে। আমাদের মতানুসারে এই দৃষ্টি দ্বারা সূক্তোক্ত জঙ্গিডের গুণের আধারের উপর জঙ্গিডমণির অর্থ যোগ্য সেনাপতিও হতে পারে।


২| শঙ্খমণি---- অথর্ব ৪.১০ সূক্ততে শঙ্খমণির উল্লেখ আছে। সায়ণাচার্য এই সূক্তেকে নিজের ভাষ্যের উত্থানিকার মধ্যে কৌশিক সূত্র ৭/৬,৭/৯ এবং নক্ষত্রকল্প ১৭ এবং ১৯ -এর অনুসারে লিখেছেন যে ----উপনয়ন সংষ্কারের পর বালকের দীর্ঘায়ু লাভের জন্য শঙ্খকে এই সূক্তের মন্ত্র দিয়ে বেঁধে দিন এবং এটাও লিখেছেন বাইরে গেলে জলে ডোবা  ইত্যাদির  ভয় উপস্থিত হলে রক্ষার জন্য এই শঙ্খের মণি রূপের এই সূক্তের মন্ত্রগুলি পাঠ করে বেঁধে নিলে, এই ভয় দূর হয়ে যাবে।


আচার্য সায়ণ দ্বারা পাওয়া এই সূক্তের মন্ত্রগুলি এই প্রকার শঙ্খের যাদু-টোন ভরা মণিপরক ব্যাক্ষাও তার জঙ্গিডমণি ইত্যাদির ব্যাক্ষাগুলির ভ্রান্তি নিতান্তই অমঙ্গল। যদি শঙ্খ বাঁধার দ্বারা এবং এই মন্ত্র পাঠ করার দ্বারা আয়ু বাড়তো ,তাহলে তো একশ বছর বা তারও বেশি বাঁচা সহজ হতো। প্রত্যেকেরই এটা করা উচিত ,যাতে তাঁরা শত বছরের আগে মারা না যান। এইভাবে বন্যার ভয় থেকে বাঁচাও বড়ো সরল উপায়।


ভারতের সব লোকেরা বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক ছোট ছোট শঙ্খের এমন মণিগুলি বেঁধে রক্ষা পান,যাতে দেশে কখনও বন্যা না আসে! এইসব হাস্যকর গল্প,যা বেদের মধ্যেই নেই। বেদের মতো মহান গ্ৰন্থে এইসব হাস্যকর ও তুচ্ছ বিষয় রাখা হয়েছে? বস্তুতঃ এই সূক্তে শঙ্খকে এক গুণযুক্ত ঔষধ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং রোগের চিকিৎসায় অনেক উপকারী হওয়ার জন্য এটাকে মণি  বলা হয়েছে। অথর্ববেদের ৪/১০/১- মন্ত্রেতে শঙ্খকে বিশ্বভেষজ অর্থাৎ অনেক প্রকার রোগের নিবারণকারী বলা হয়েছে। অথর্ব ৪/১০/১ -মন্ত্রে 'কৃশনঃ' অর্থাৎ রোগগুলিকে দূর্বল করে দূর করার কথা বলা হয়েছে। দ্বিতীয় মন্ত্রে এটি শরীরকে খেয়ে ফেলে  যে (অত্রিণঃ) রোগ তথা কৃমিরূপ শত্রুদের হত্যাকারী বলা হয়েছে । তৃতীয় মন্ত্রে  বলা হয়েছে যে,শঙ্খের সেবন দ্বারা অনেক প্রকার রোগ (অমীবা) মস্তক বা বুদ্ধির দুর্বলতা,পাগলপনা ইত্যাদির (অমতিম্) তথা পীড়া দেখে কেঁদে অন্য রোগকে দূর করার উপায় বলা হয়েছে। চতুর্থ মন্ত্রে এটি সেবনে আয়ুবর্ধক বলা হয়েছে।ষষ্ঠ মন্ত্রে শঙ্খকে হিরণ্য (স্বর্ণ) তথা সোমের মতো রোগনিবারণ গুণ বলা হয়েছে।সূক্তের অন্তিম সপ্তম মন্ত্রে বলা হয়েছে যে ,শঙ্খের সেবন দ্বারা ১০০ বছর দীর্ঘায়ু প্রাপ্ত হয়,বল প্রাপ্ত হয়।চিকিৎসকগণ শঙ্খের সূক্ষ্ম ছাই তৈরির পর এটাকে ওষুধ হিসাবে প্রয়োগ করেন। আয়ুর্বেদের অনেক গ্ৰন্থে শঙ্খের ভস্ম অনেক রোগে ব্যবহারের উপকারিতা বলা হয়েছে।


শঙ্খ হলো সমুদ্রের এক জীবের খোলসযুক্ত রক্ষক।এই শঙ্খ ঐ জীবের সাথে বাড়তে থাকে।এটা এর সমতুল্য।এই কথা অথর্ববেদের মন্ত্রে ৪/১০/৩-এ অস্থি শব্দ দ্বারা স্পষ্ট হয়েছে।জলের মধ্যে শঙ্খ ঢেলে বাচ্চাকে পান করালে তার অনেক রোগ দূর হয়ে যায়। এই বিধি মহারাষ্ট্রে অধিক প্রচলিত। চিকিৎসকীয় দৃষ্টিতে বাচ্চাদের গলায় শঙ্খেরমণি বাঁধার প্রথা আজও আছে। ছোটো শঙ্খ সোনার সাথে জোড়া লাগিয়ে অলংকারের মতো ছোটো বাচ্চাকে পরানোর প্রথাও আছে ।এতে লাভ দেখা গিয়েছে।এটা ডাঃ কপিল দেব দ্বিবেদী লিখেছেন।


পন্ডিত বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার নিজের অথর্ববেদ ভাষ্যে শঙ্খমণি দ্বারা শঙ্খভস্মের অভিপ্রায় লিখেছিলেন তিনি অথর্ববেদের ৪/১০/১-মন্ত্রে পঠিত হিরণ্যজাঃ শঙ্খঃ -এর অর্থ হিরণ্য ভস্মমিশ্রিত শঙ্খভস্ম লিখেছেন। তিনি লিখেছেন যে  অথর্ব ৪/১০/৩ মন্ত্রে যে অস্থিময় শঙ্খের আয়ু-বৃদ্ধি ইত্যাদির কারণ বলা হয়েছে,তা সম্ভব নয়।এটা তখনই সম্ভব,যখন এটার অর্থ শঙ্খভস্ম করবে।এই অর্থ সমগ্ৰ সূক্তের অর্থের অনুকূলও।


৩| শতবারমণি----


অথর্ব ১৯/৩৬ সূক্তে শথবারমণির বর্ণনা আছে।এই সুক্তের নিজের ভাষ্যের উত্থানিকাতে আচার্য সায়ণ লিখেছেন,যেই ব্যক্তির সন্তার মারা যান এবং ওনার বংশের রক্ষা করতে চান, তিনি এই সূক্তের মন্ত্র পাঠ করে শতবারমণিকে বেঁধে নিলে তাঁর ঐ সংকট দূর হয়ে যাবে।যেখানে অথর্ববেদের শতবারমণির বর্ণন কোন যাদু-বিদ্যায় ভরা মণির রূপে করা হয়নি, সেখানে এক বল বীর্য এবং শক্তিবর্ধক ঔষধের রূপে করা হয়েছে।যদি যাদু-বিদ্যার কথায় হতো তাহলে ,যেকোনো ব্যক্তি এই ঔষধের মণি বেঁধে নিতেন এবং এই সূক্তের মন্ত্রকে পাঠ করতেন,তবে কখনোই কোনো সন্তান মরতো না বা কখনও এমন হতো না যে তার  ঘরে সন্তান আসবেই না। যদিও সূক্তের মধ্যে এই বিষয়ে ঔষধি শব্দের প্রয়োগ না হলেও,এর গুণের বর্ণনা এর মধ্যে মিলেছে,যার দ্বারা এই ঔষধি সিদ্ধ হয়েছে।



সায়ণাচার্যও সূক্তের মন্ত্রের নিজের ভাষ্যের মধ্যে শতবারকে এক ঔষধিই বলেছেন।সূক্তের প্রথম মন্ত্রের মধ্যে বলেছেন যে,শতবার নিজের সামর্থ্য দ্বারা অনেক যক্ষ্মা অর্থাৎ রোগগুলিকে তথা রোগের জনক কৃমিদের (রক্ষাংসি) নষ্ট করে দেয়।এই ওষুধটি  এমন কি সেই রোগগুলিকেও নষ্ট করে  যেগুলোকে বাঁকা ,চাপা   বা কষ্ট করে নষ্ট করতে হয়। তৃতীয় মন্ত্রে বলেছেন যে এই ঔষধি ছোটো রোগগুলিকেও দূর করার শক্তি রাখে। বড়ো রোগের বিনাশ করার সামর্থ্যও রাখে অর্থাৎ পীড়ার মধ্যে  রোগীর কান্না, চিৎকার , সেটাও নষ্ট করে দেয়।চতুর্থ মন্ত্রে বলা হয়েছে 'শতবার'-এ এতই পুরুষত্ব তৈরি করার শক্তি আছে  ,যে ব্যক্তি একটাও সন্তান উৎপন্ন করতে পারে না, তিনি অনেক সন্তান উৎপন্ন করতে পারবেন।এই বীর্যের অনেক প্রকারের দোষ ও রোগগুলিকে দূর করার শক্তি রাখতে হয়। আচার্য সায়ণ 'শতবার' এর  ঔষধির নামের ব্যাক্ষা দুইপ্রকারে করেছেন ---


এক তো উনি এটা বলেছেন যে,এর মূল শত শত অর্থাৎ অনেক মূল,মোটা ,বড়ো কন্দ থেকে বেরিয়েছে,আর দ্বিতীয় অর্থতে উনি এটাই বলেছেন যে এরমধ্যে অনেক রোগ প্রতিরোধ করার শক্তি আছে।পুরুষত্ব বা বীর্যবর্ধক ঔষধের মধ্যে এই শক্তি তো আছেই।পঞ্চমমন্ত্রে 'শতবার 'কে হিরণ্যশৃঙ্গও বলা হয়।


আচার্য প্রিয়ব্রত বেদ বাচস্পতির মতে,যার একটি ভাবনা দেখে মনে হয়, এর  কন্দের অগ্ৰভাগ  সোনার মতো চকচকে ও উজ্জ্বল।একটাই ধ্বনি এর থেকে বের হয় ,যার মধ্যে হিরণ্য অর্থাৎ সোনার মতো ঔষধি গুণ এবং  এটা রোগের শৃঙ্গকে  এফোঁড় -ওফোঁর করে দেয় অর্থাৎ নষ্ট করে দেয়।এর থেকে এই ধ্বনিও নির্গত হয় যে স্বর্ণের সাথে এর প্রয়োগে এটি আরও গুণযুক্ত হবে। এই সত্য কথা পরীক্ষা করে দেখা যাক। দ্বিতীয় মন্ত্রে  এর দুটি শিং -এর কথাও বলা আছে।এতে প্রতিপন্ন হয় যে এর কন্দের মধ্যে দুটি শিং যা অগ্ৰভাগে বের হয়। পঞ্চম মন্ত্রে এই ঐষধিকে ঋষভও বলা হয়েছে।ঋষভের অর্থ ষাঁড়ের মতো অনেক শক্তিশালী।এর এটাই ভাবার্থ যে, রোগের নিবারণে এই ঔষধি খুব শক্তিশালী।এই শব্দের অর্থ ষাঁড়ের মতো বীর্য উৎপাদনে সক্ষম অর্থাৎ অনেক সন্তান উৎপন্ন করারও সামর্থ্য আছে।যে ঔষধি পুরূষত্ব ও বীর্যবর্ধক,তার এই গুণ তো থাকবেই। আয়ুর্বেদের গ্ৰন্ত্রের মধ্যে বাজীকরণ বা বীর্যবর্ধক ঔষধির রূপে ঔষধের নাম ঋষভ বলা হয়েছে।


৪| বৈয়াঘ্রমণি------


এই মণির উল্লেখ অথর্ব ৮/৭/১৪ মন্ত্রে আছে। কৌশিক ও বৈতান সূত্র অনুসারে আচার্য সায়ণ এই সূক্তের উত্থানিকার মধ্যে লিখেছেন যে-----যক্ষ্মা ইত্যাদি সকল ব্যাধির চিকিৎসার জন্য এই সূক্তের মধ্যে দশবৃক্ষের টুকরো দিয়ে লক্ষাধিক  সুবর্ণ দিয়ে মণি বানানো। গুগল,জামুন,কবীলা,স্রক্,বঙ্ক,সিরস,বরণ,বেল,,জঙ্গিড,কুটক,গৃহ্ম ,গলাগল,বেত,শিম্বল,সিপুন,তিনশ,অরনিকা,অহমযোক্ত,তুন্যু এবং পুতদারু---এগুলিকে শান্ত বৃক্ষ বলে। এর দ্বারা দশবৃক্ষের টুকরো থেকে নির্মিত মণিকে শকলমণি বলা হয় আর সৌত্রামণা যোগে এই সূক্ত দ্বারা ঔষধি গুলি আকর্ষিত হয়ে সুরার মতো আমন্ত্রণ করে।

অথর্ব ৮/৭ সূক্তে ২৮ মন্ত্র আছে।যেখানে পাপের ফল হিসেবে যক্ষ্মাকে বলা হয়েছে।এই সূক্তে ১৪ মন্ত্রে বৈয়াঘ্রমণির বর্ণনা আছে।মন্ত্র এই প্রকার----


वैयाघ्रो मणिर्वीरुघां त्रायमाणोऽभिशस्तिपाः।

अमीवाः सर्वा रक्षांस्यपहन्त्वधि दूरमस्मत्।।।


অর্থাৎ বীরুধাম্-বিরোহণ স্বভাবযুক্ত  লতা ইত্যাদির মধ্যে বৈয়াঘ্রঃ বিরুধ মণি  সর্বশ্রেষ্ঠ রত্ন,ত্রায়মাণঃ ঠহয় মণি পালনকর্তা,অভিশস্তিপাঃ তথা দৈনন্দিন হিংসা থেকে রক্ষা করে।অমীবাঃ--রোগগুলি বা রোগযুক্ত কীটাণুগুলি তথা--রক্ষা করে সব রাক্ষসী কর্মকে, অপহন্তু-এ হনন করে অর্থাৎ আমাদের থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।



বৈয়াঘ্রের অর্থ ব্যাঘ্রবত্ রোগের উপর আক্রমণকারী ব্যাঘ্র হল বৈয়াঘ্র।ব্যাঘ্রের অভিপ্রায়  ভেরেন্ডা গাছ।আপ্টেনে স্বার্থের মধ্যে অন প্রত্যয় মেনে বৈয়াঘ্র পদ সিদ্ধ হয়েছে এবং 'ব্যাঘ্র'কে 'The red variety of the castor-oil' মানা হয়।


উপর্যুক্ত সূক্তের মধ্যে ব্যাঘ্রকে ঔষধির মণি বলা হয়,ইহা বীরুধের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। ভেরেন্ডা গাছের মণি এইজন্য বলা হয়েছে যে  কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য এটি সর্বোত্তম তেল। রোগের কারণ  হলো কোষ্ঠকাঠিন্য।কোষ্টকাঠিন্যকে ঠিক রাখার পর রোগ প্রায় থাকে না। ব্যাঘ্রপদঘটিত অন্য ঔষধগুলিও যথাক্রমে ব্যাঘ্রপুচ্ছ,ব্যাঘ্রপাত্।


 উপর্যুক্ত বর্ণনাতে সায়ণভাষ্য কিভাবে টেকে? এটা নিজেই দেখা দরকার ।সমস্ত রোগ পেট খারাপের দ্বারা বৃদ্ধি  হয়। বেদে 'অমিবা' রোগের কীটানুদের বলা হয়েছে। অতএব এটি সায়ণের দ্বারা বলা মণিবন্ধন প্রকার থেকে কিভাবে দূর করা যাবে? এই ৮/৭ সূক্তের মধ্যে ত্রাণসংবন্ধী,পুরুষজীবনী,বলাসরোগনাশক,হৃদয়কল্যাণকারী এবং রোগনাশক পীপল,দর্ভ ইত্যাদি ঔষধগুলির বর্ণনা করা হয়েছে। এই ক্রমে 'বৈয়াঘ্র'-এর ঔষধও অত্যন্ত উপযোগী মণিরূপে বর্ণনায় এসেছে।মনুষ্যদের উচিৎ এটার যথোচিত প্রয়োগ করা।লক্ষণীয় এই যে,সূক্তে মণি শব্দটি শুধুমাত্র বৈয়াঘ্রের সাথে মণি পদের প্রয়োগ করা হয়েছে,অন্যান্য ওষুধের সাথে নয়।।এটা তার  মহত্বের ইঙ্গিত  করেছে।


৫| অশ্বত্থমণি 


 সায়ণ আচার্যের অনুসারে 'অশ্বত্থমণি '-এর বর্ণনা অথর্ব ৩/৬ মন্ত্রে আছে।যদিও মন্ত্রের মধ্যে কোথাও 'মণি শব্দ'-এর উল্লেখ নেই। ভাষ্যকারগণ এই সূক্তের দেবতা 'वानस्पत्याश्वत्ष' লিখেছেন। আচার্য সায়ণ এই সূক্তের উত্থানিকাতে লিখেছেন যে----অভিচারকর্ -এ এই সূক্ত দ্বারা খয়েরের সাথে পীপলের মণির সম্মান এবং আমন্ত্রণ করে শত্রুর মর্মে চাপিয়ে দেওয়া হয়।তথা এই সূক্ত দ্বারা পূর্ববতী লুপকে আমন্ত্রন করে  'तेऽधराञ्चः' এই সপ্তম ঋচা দ্বারা নদী প্রবাহে ছুঁড়ে দেবে।একই প্রকারে প্রথমের সমান আমন্ত্রিত লুপকে অষ্টম ঋচা দ্বারা প্রেরণ করে।তথা এটি অভিরচিত ও অভিমানের জন্য বিহিত মহাশান্তির মণিবন্ধনেও পাঠ করা হয়েছে।

উপর্যুক্ত সূক্তের মধ্যে আট মন্ত্র আছে।যার মধ্যে ' पुमान् पुंसः 'দার্ষ্টান্ত (উপমেয়) -এর বর্ণনা  'অশ্বত্থঃ খদিরাত্' এই দৃষ্টান্ত রূপে হয়েছে। দ্বিতীয় মন্ত্রে উপমান- অশ্বত্থ এবং উপমেয়-পুমান্ দুয়েরই বর্ণনা আছে।অশ্বত্থ রোগ শত্রুদের বিনাশক।এই অর্থের মধ্যে ইন্দ্র হলো বিদ্যুৎ,মিত্র হলো সূর্য,বরুণ হলো মেঘ। এই তিনের  সহায়তা দ্বারা অশ্বত্থ বাড়তে থাকে,তাই  তিনি তাদের  স্নেহ  করেন,উপমেয় -পুমান্ রাষ্ট্রীয়  শত্রুদের  বিনাশ করেন।এই অর্থে ইন্দ্র হলো সম্রাট,মিত্র রাজা তথা বরুণ হলো মাঙ্গলিক রাজা।



অন্তিম মন্ত্র  'বৃক্ষস্যশাখয়াশ্চত্ষস্য নুদামহে'---দ্বারা ইহা জ্ঞাত হয় যে,'অশ্বত্থ' প্রকরণ দ্বারা বৃক্ষই হয়।'নুদামহে' দ্বারা জ্ঞাত হয় যে শত্রুদেরকে  ধাক্কা দেওয়ার  অনেকেই আছে । এরা প্রজারা। যখন সমস্ত প্রজা মিলে 'রাষ্ট্রীর শত্রু-স্বকীয় রাজা' -র রাষ্ট্র থেকে ধাক্কার জন্য তৎপর হয়ে যায়,তখন বৃক্ষের শাখাগুলির প্রহার দ্বারাই শত্রু রাজাকে নিজের রাষ্ট্র থেকে দূর করতে পারে, কোনো উগ্ৰ শাস্ত্রার্থের আবশ্যকতা হতো না,এটা মন্ত্রতে দেখানো হয়েছে।


পন্ডিত সাতবলেকর-ও এই সূক্তে 'অশ্বত্থের অন্যোক্তি' নাম দ্বারা ব্যাক্ষা করেছেন। তিনি লিখেছেন এই সূক্তে  অশ্বত্থের অন্য উক্তি' আছে।একটিকে  প্রত্যক্ষ উল্লেখ করে, অন্যটির কথা বলাকে অন্যোক্তি বলে। এই প্রকারে যেখানে অশ্বত্থ বৃক্ষের বর্ণনা করতে গিয়ে বীরপুরুষের বর্ণনা করা হয়েছে।


(খ)  রাজনীতিপরখ মণিসূক্ত


১| পর্ণমণি:----

রাজনীতিপরখ মণিসূক্তের মধ্যে প্রথমে পর্ণমণি (অথর্ব ৩/৫) কে নেওয়া হয়েছে।উত্থানিকাতে নিজের ভাষ্যতে বিনিয়োগকারী ও অনুক্রমণিকাকারীদের অনুসরণ করতে গিয়ে আচার্য সায়ণ লিখেছেন, যে ব্যক্তি তেজ,বল,আয়ু ও ধন ইত্যাদিকে প্রাপ্ত করতে চান, তিনি পর্ণ অর্থাৎ ঢাকের বৃক্ষের বানানো মণিকে তেরোতম দিনে দই ও মধু মিশিয়ে ভিজিয়ে তিনদিন রেখে চতুর্থ দিনে বের করে ঐ মণির এই সূক্তকে পাঠ করে বেঁধে নিন। আচার্য প্রিয়ব্রত বেদ বাচস্পতির মতে আচার্য সায়ণ এই সূক্তের উত্থানিকাতে এটাও লিখেছেন যে,যদি কোনো রাজার রাজ্য  কোনো শত্রু ছিনিয়ে নেয় , তাহলে এই কাম্পীল নামক বৃক্ষের  দ্বারা,যে বৃক্ষের প্রথমে কেটে নেওয়া শাখার স্থানে পুনরায় শাখা জন্মে,সেখানে আগুন জ্বালিয়ে তার উপর চাল রান্না করে , ক্ষেত  করার পর,পুরানো ধান থেকে পুনরায় বের হওয়া শিকড় দ্বারা প্রাপ্ত করা যায়,এই সূক্তের মন্ত্রকে উচ্চারণ করে খান তাহলে তিনি পুনরায় তাঁর রাজ্য ফিরে পাবেন।যিনি সায়ণাচার্যের  ধনাদি প্রাপ্তির জন্য এই বাক্যতে যে 'আদি' শব্দের প্রয়োগ করেন,তার থেকেও পর্ণমণির মহিমা দ্বারা ছিনিয়ে নেওয়া রাজ্য প্রাপ্তির কথা সমাবিষ্ট হয়, কেননা সূক্তের মন্ত্রেও পর্ণ দ্বারা ক্ষত্র ও রাষ্ট্রের অভিবর্গ দ্বারা রাজ্যপ্রাপ্তির পার্থনা করা হয়েছিল। আচার্য সায়ণ দ্বারা কৃত 'পর্ণমণি' শব্দের অর্থ এই প্রকার যে যাদু ভরা ঢাক দিয়ে বানিয়ে বিশেষ প্রকার মণি করা বুদ্ধিসংগত নয়।যদি সায়ণের অর্থ ঠিক মেনে নিই তাহলে কোনোও রাষ্ট্র নিজের স্বতন্ত্রতা  হারিয়ে পরাধীন হতো না।ঐ রাষ্ট্রের জনতা বাসিত মণি বেঁধে নিত এবং দই মধু খেয়ে নিত,তথা উক্ত বাসিতর কাছে শাখার উপর চাল রান্না করে খেয়ে নিত। স্বতন্ত্রতা না হারাতে এবং পরাধীন না হতে চাইলে এটা খুব সহজেই হতো।ভারতের বাইরের লোকেদের তো বেদ জ্ঞান নেই,তাহলে এই ঔষধি-গুণ জেনেও ভারতের আর্যরাও (হিন্দুরা) তো পরাধীন থাকতে পারতো না।



এখানে তো সর্বদা  বেদের পঠনপাঠন হয়। তবুও শত্রুকে তাড়িয়ে স্বাধীন হওয়ার এই সহজ উপায়  পেয়েও কেন‌ ভারতবর্ষের মানুষ শতাব্দির পর  শতাব্দি  পরনির্ভরশীল ছিল ? এইজন্য সায়ণ আদির বলা 'পর্ণমণি'-র সূক্তের এই অর্থ সত্য ও মানার যোগ্য নয়।


বেদোপাধ্যায় প্রফেসর বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার 'পর্ণমণি ' শব্দ দ্বারা পালকসেনাপতি,রত্নসেনাধ্যক্ষ,যিনি রাষ্ট্রের পালকরত্ন এই অর্থ লিখেছেন এবং তদনুসারে পুরো সূক্তের সংগতি করেছেন। কিন্তু আচার্য প্রিয়ব্রত বেদবাচস্পতি 'বেদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ' নামক বৃহৎ গ্ৰন্থের প্রথম ভাগে 'পর্ণমোচী' নামক  নবম অধ্যায়ে এই সূক্তের বিস্তৃত ব্যাক্ষা করেছেন। যেখানে আচার্যশ্রী 'পর্ণমোচী'-র অর্থ নির্বাচনের জন্য   মতদাতাদের দ্বারা ভোটারদের নাম দিয়েছিলেন অর্থাৎ মতপত্র (Ballot paper) দিয়েছিলেন।একজন মত বা ভোটপার্থীর কাছে ব্যালট পেপারের  (মতপত্র)চেয়ে মূল্যবান আর কিছু হতে পারে না। এইজন্যই তো   তিনি মণিরূপ।  এইজন্য সূক্তের মধ্যে  'মতপত্র'কে  'পর্ণমণি' বলা হয়েছে।'পর্ণ 'ও 'মণি' এই দুই শব্দের যোগ দ্বারা পর্ণমণি শব্দ তৈরি হয়েছে।পর্ণের অর্থ হলো কাগজ আর মণির অর্থ যেমনটি এর উপর আমরা লিখেছি, যা অত্যন্ত উপযোগী ও মূল‌্যবান বস্তু । অতএব পর্ণমণির অর্থ হবে  'এক বহুমূল্য পত্র' প্রজাতন্ত্রের মধ্যে এই মতপত্র দ্বারা রাজা নির্বাচিত হন।অতএব এটা বলশালী।রাষ্ট্রের এই বর্গ দ্বারা এর উপযোগ হয়। আচার্য  প্রিয়ব্রত দ্বারা নির্দিষ্ট এই অর্থের সংগতি অথর্ববেদের এই উপর্যুক্ত সূক্ত সঠিক ঘটনা , কেননা এর দ্বিতীয়, তৃতীয়,সষ্ঠ ও সপ্তম মন্ত্রের মধ্যে স্পষ্ট রূপ দ্বারা এক অভ্যর্থনা  দ্বারা শব্দ প্রাপ্তির অর্থাৎ এর রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার প্রার্থনা কার্যরূপ শৈলির মধ্যে পর্ণ থেকে আসে। যে মন্ত্র স্পষ্ট রূপ দ্বারা সূক্তের মূখ্য আশয়কে ব্যক্ত করতে থাকে।


(২) প্রতিসরমণি---- অথর্ববেদ ৮/৫ - এর মধ্যে প্রতিসরমণির উল্লেখ পাওয়া যায়। এই সূক্তের উত্থানিকাতে আচার্য সায়ণ তথাকথিত বিনিয়োগের আধারের উপর লিখেছেন যে, অয়ং প্রতিসরঃ ,অথর্ব (৮/৫) ইত্যাদি দুটি সূক্তকে অর্থসূক্ত বলা হয়,এই অর্থসূক্তের অভিলষিত প্রয়োজনকে সিদ্ধ করার জন্য প্রয়োগ করা যায়। এই অর্থসূক্ত দ্বারা দই ও মধু তিনরাত বসিয়ে রেখে তিলকমণিকে সম্পাদন ও আমন্ত্রণ করে বাঁধতে হবে।এই সূক্তটি কৃত্যাপ্রতিহরণগণের মধ্যেও পাঠ করা হয়। অতএব এটি শান্তিজলের আমন্ত্রণ ইত্যাদির মধ্যে বিনিয়োগ হয়।পিষ্ঠ রাত্রি বিধানের প্রতিসর বন্ধনেও এই সূক্তের পাঠ হয়,যার মধ্যে রক্ষাসূত্র বাঁধা যায়।



আচার্য সায়ণ উক্ত সূক্তের প্রথম মন্ত্রের ভাষ্যতে এই মণিকে তিলকবৃক্ষ দ্বারা নির্মিত মেনেছেন ---অথ তিলকবৃক্ষনির্মিতোমণিঃ, দয়ানন্দ বিচারধারার আলোকে উক্ত সূক্তের মধ্যে সম্রাট, রাষ্ট্রপতি তথা পুরুষমণি রূপে সেনাধ্যক্ষেরই চর্চা হয়েছে।এটির  মধ্যে প্রথমে দুই মন্ত্রের মণির যে শূরবীর,সপত্নঘ্ন,সুমঙ্গল,সহস্বান,বাণী ইত্যাদি বিশেষণ পঠিত হয়  তার সঙ্গে কাষ্ঠ নির্মিত মণির  সম্বন্ধ নেই। কারণ বিশেষণের অনুরূপ বিশেষ্য ব্যক্তি বা বস্তু নয়, তাহলে বিশেষণ গল্পই হবে। তৃতীয় মন্ত্রের মধ্যে বলা হয়েছে যে সেনাধ্যক্ষরূপী পুরুষ রত্ন দ্বারা সম্রাট -(ইন্দ্র) -এর শত্রুদল (বৃত্র) কে হত্যা করা হয়েছে।এটা  কি এই  মন্ত্রোক্ত বর্ণন 'কাষ্ঠনির্মিত মণি' দ্বারা সম্ভব? চতুর্থ মন্ত্রে এই মণিকে স্রাক্ত্যঃ বলা হয়। 'স্রাক্ত্যমণি' বস্তুতঃ হৈ-স্রক্ (স্রজ) অর্থাৎ মালা দ্বারা সৎকার যোগ্য বিজয়ী সেনাধ্যক্ষরূপী পুরুষরত্ন।এই সম্বন্ধের মধ্যে প্রস্তুত সুক্তোক্ত বর্ণন 'স্রক্ত্য' দ্বারা অথর্ব ২/১১/২ মন্ত্রের মধ্যেও হয়েছে। স্বার্থে অন্‌ প্রত্যয় যোগ দ্বারা স্রক্ত্য থেকে স্রাক্ত্য পদ নিষ্পন্ন হয়েছে। আচার্য সায়ণ যেখানে--অথর্ব (২/১১/২) এই মন্ত্রকে তিলক বৃক্ষ দ্বারা নির্মিত বলেছেন।যথা---'স্রক্তিস্তিলকবৃক্ষঃ তত্র ভব স্রক্ত্যঃ'। অথর্ব ২/১১/৪ মন্ত্রে 'স্রক্ত্য'কে সূরি বলা হয়।সূরির অর্থ সায়ণ ,'অভিদা' অর্থাৎ জ্ঞানী বলেছেন।কাষ্টনির্মিত এই ফলরূপ বস্তু জ্ঞানী হতে পারে কি? অথর্ব ৮/৫ এর মন্ত্রে সাত ও আট এর মধ্যেও ক্রমশঃ 'স্রাক্ত্যং মণিং' ' স্রাক্ত্যেন মণিনা' পদগুলির প্রয়োগ হয়েছে। যার অর্থ 'সৎকার যোগ্য পু্রুষরত্ন (সেনাধ্যক্ষ)' এবং 'সৎকার  যোগ্য পুরুষরত্ন সেনাধ্যক্ষ দ্বারা' হয়। মন্ত্র এগারোতে এই মণিকে  'উত্তম ঔষধিনাম্' এবং 'ব্যাঘ্রঃ শ্বপদাম্ ইব' বলে। ঔষধিগুলির দুটি প্রয়োজন রোগের দোষগুলির অর্থাৎ রোগকে দূর করতে এবং তার শরীরকে সংবর্ধন করতে। 


রাষ্ট্রেরও দুটি প্রয়োজন হয়,রাষ্ট্র শরীরের রোগকে দূর করে এবং রাষ্ট্র শরীরকে সংবর্ধন করে।রাষ্ট্র শরীরের রোগ হল চুরি,উকৈতি, লুটপাট,ব্যাভিচার,বিপ্লব তথা উপদ্রব ইত্যাদি।রাজা সেনাধ্যক্ষের সহায়তা দ্বারা ব্যবসা ,উদ্যোগ, কৃষি ইত্যাদি দ্বারা রাষ্ট্রের সমর্থন করেন। অতএব তাকে 'উত্তম ঔষধিনাম্' বলে। অবশিষ্ট মন্ত্রগুলির সহায়তা দ্বারা ব্যবসা, উদ্যোগ, কৃষি, ইত্যাদি দ্বারা রাষ্ট্রকে সংবর্ধন করা হয়।এর দ্বারা অতিরিক্ত এক রাজনৈতিক রোগ আছে---'পর রাষ্ট্র দ্বারা আক্রমণ' এতদর্থ রাজার  সেনাধ্যক্ষকে ব্যাঘ্র দ্বারা উপমিত করা হয়েছে (ব্যাঘ্রঃ শ্বপদামিব)।এটা কি আচার্য সায়ণ দ্বারা ইঙ্গিত কাষ্ঠনির্মিত মণির মধ্যে উপপত্র হতে পারে? এটাই বিচারণীয় কথা।মন্ত্র বীসের মধ্যে এর এক বিশেষণ 'দেবমণি'ও এসেছে।


এর অর্থ হল হে দিব্যগুণি মণি অর্থাৎ পুরুষরত্ন সেনাধ্যক্ষ।যিনি চেতন পুরুষের মধ্যে  সার্থকভাবে বসেন, অচৈতন্য কাষ্ঠের মধ্যে নন। মন্ত্র ২০-এর মধ্যে 'অস্মিনিন্দ্রো নিদধাতু নৃম্ণম্' এবং মন্ত্র ২১- এটি 'ইন্দ্রো বধ্নাতু তে মণিম্' বলা হয়েছে।যার অর্থ হল-- হে রাজা( ইন্দ্র) এই মণিরূপ সেনাধ্যক্ষের মধ্যে বল ও ধন (নৃম্ণম্) নিধিরূপের মধ্যে স্থাপিত করুন। হে রাষ্ট্রের রাজন! সম্রাট (ইন্দ্র) তোমার রক্ষার জন্য তোমার সাথে পুরুষরত্ন সেনাধ্যক্ষকে সুদৃঢ় করুন।এই  দুই অর্থ   কি বিনিয়োগের উপর আধারিত সায়ণকৃত 'কাষ্ঠনির্মিত মণি'র মধ্যে ঘটতে পারে?

অভীবর্তমণি:------১/২৯ এই মন্ত্রের মধ্যে এই মণির উল্লেখ মিলেছে।এই সূক্তের উত্থানিকাতে আচার্য সায়ণ লিখেছেন যে,এটি মাহেন্দ্রী মহাশান্তির মধ্যে ও এই সূক্তের প্রথম চার ঋচাগুলি শত্রুমর্দিত রাষ্ট্রের বৃদ্ধির জন্য, বিনিয়োগ হয়।লোহা, সীসা,,রূপা,তামা দিয়ে সোনার প্রলেপ দিয়ে ত্রয়োদশী থেকে তিনদিন দই ও মধু দ্বারা ভর্তি পাত্র রেখে তারপর সূতোয় বেঁধে কুশের উপর রেখে   তার জন্য যজ্ঞ করতে হবে এবং পরে তাকে অভীবর্ত ও উত্তমা দ্বারা বাঁধতে হবে।


 আচার্য সায়ণ 'অভিবর্তমণি'-র অর্থ 'চক্রনেমিনির্মিতমণি ' করেছেন।সায়ণ ভাষ্যের অনুসারে এটাকে ধারণ করার দ্বারা রাষ্ট্রীয় শক্তি বৃদ্ধি পায়।এটি শত্রুদের নষ্ট করে। আক্রমণকারীদের নিরষ্কৃত  করে এবং রাষ্ট্রের অভিবৃদ্ধি করে। সূর্য ও চন্দ্রমা অভিবর্তমণিকে পুষ্ট করে।এটাকে ধারণকারী সকল প্রাণীদের সহযোগ প্রাপ্ত করে।আর এর তেজ সূর্যের মতো বাড়তে থাকে এবং এই সব শত্রুদের নষ্ট করার সামর্থ রাখে।


স্বামী দয়ানন্দের বিচারধারার আলোকে 'অভিবর্তের' অর্থ হলো পররাষ্ট্র বা শত্রুর‌ সম্মুখীন হওয়া  মণিরূপ পুরুষরত্ন সেনাধিপতি।


अभिवर्तते अनेन इति अभिवर्त सेनाधिपतिः।


 উক্ত সূক্তের মন্ত্র দুটি  থেকে 'অভিবৃত্য' পদ এসেছে যার অর্থ হল 'ঘেরকর'।অভিবর্ত সেনাধিপতি ইনি হলেন, যিনি বিদ্রোহী প্রজাদের রাজ্যকর প্রদান করেননি এবং যারা দুষ্ট কর্ম (যুদ্ধ) করার ইচ্ছাকারী অভিবৃত্য--ঘেরাও করে নিজপাদাধীন করে নেন। মন্ত্র ৩ ও ৪ - এর মধ্যে অভিবর্তের জন্য 'সপত্নক্ষয়ণঃ' 'শত্রুতা' এবং 'সপত্নহা' বিশেষণ এসেছে, যেখানে এমনই পুরুষরত্ন মণিরূপ সেনাধিপতির উপরই ঘটে থাকে,'চক্রনেমিনির্মিত মণি'-র উপর নয়। শত্রুদেরকে ক্ষয়কারী এমনই সেনাধিপতির সাথে রাষ্ট্রপতির জন্য রাজা দৃঢ়বন্ধনের অভিলাষ করেন--- 'राष्ट्राय महां वध्यतां सपत्नभ्यःपराभुवे'।


পন্ডিত দামোদর সাতবলেকর --অভিবর্তের অর্থ 'শত্রু'কে ঘেরাওকারী বলেছেন। তিনি এই অভিবর্তমণিকে রাজদন্ড,ছত্র ,চামর ইত্যাদির তরফে এক রাজচিহ্ন মানেন,যেটা ধারণ করার সময় উক্ত সূক্তকে বলে যেতে হবে। তিনি  লিখেছেন ----ছত্র,চামর,রাজদন্ড ইত্যাদি চিহ্ন ধারণ করলে জনতার উপর বিশেষ প্রভাব পড়ে এবং এই প্রভাবের কারণে রাজার চারিদিকে শক্তি কেন্দ্রীভূত হয়ে যায়।যদিও এই প্রত্যেক চিহ্নের মধ্যে বিশেষ শক্তি নেই, তবুও এই রাজচিহ্ন ধারণকারী সাধারণ সিপাহীর মধ্যেও অন্য সাধারণ জনের অপেক্ষা কিছু বিশেষ শক্তি হওয়ার অনুভব করে।এই প্রকারে উক্ত চিহ্নের কারণে অমূর্ত এক রাজশাসনের এই বিশেষ প্রভাব জনতার উপর পড়ে। যার কারণে রাজা শক্তির কেন্দ্রবিন্দু হোন।যেই সময় নিজের চিহ্ন দ্বারা এবং সম্পূর্ণ ঠাঠের দ্বারা রাজা হন,সেই সময় তাঁর বড়ো প্রভাব সামান্য জনতার উপর পড়ে,এই কারণে রাজার মধ্যে শক্তি জমা হয়। এই সূক্তের চতুর্থ মন্ত্রে (অভিবর্তো০) এই মণিই শত্রুনাশ  করে,প্রভাব বাড়ায়, রাষ্ট্রের হিত সাধন করে ইত্যাদি বলা হয়েছে। তার ভাবার্থ উক্ত প্রকারেই বোঝার যোগ্য। সিপাহির শক্তি তাঁর চিহ্ন দ্বারা আসে ও এই শক্তি বাস্তবিক নয় , এটি শুধুমাত্র একটি বিশেষ ভাবনা থেকে উৎপন্ন হয়। সম্পূর্ণ রাজচিহ্নের শক্তি এই প্রকার ভাবনাত্মক হয়।


৪| অমৃতমণি----


এই মণির উল্লেখ অথর্ববেদ ১৯/৪৬ এই মন্ত্রে আছে।মারুদ্রণী মহাশান্তির মধ্যে এর প্রয়োগের ইঙ্গিত করে, আচার্য সায়ণ এই সূক্তের উত্থানিকাতে লিখেছেন যে, 'প্রজাপতিষ্ট্রা' এই সূক্তের দ্বারা বলকামের মারুদ্রণী শান্তি করে।এই মহাশান্তির অস্তৃতানামক মণিকে আমন্ত্রণ করে বাঁধতে হবে।এই ১৯/৪৬ সূক্তের মধ্যে অস্তৃতানামক স্তুতি আছে।প্রথম  মন্ত্রের ভাষ্যের মধ্যে আচার্য সায়ণ লিখেছেন যে:-------

'অত্র সূক্তে অমৃততাখ্য মণিঃ স্তুয়তে। 'অস্তৃতস্ত্বভিরক্ষতু' ইতি চরমপাদে সর্বত্র যুষ্মচ্ছষ্দেন অস্তৃতমণিধারকঃ পুরুষোऽভিধীয়তে। প্রজাপতিঃ প্রজানাং পালকঃ সর্ব জগদ্ধিয়াতা দেবঃ প্রথমম্ সৃষ্টয়াদৌ মণিধারকেভ্যঃ পূর্ব বা অস্তৃতম্ পরৈরবাধিতম্ এতত্সংজ্ঞকং ত্বা ত্বাম্ বধ্নাত্ ধারয়ামাস।ত্রিবৃন্মণিরেব বা অতিশয়িতপ্রভাবত্বাদ্ অস্তৃতসংজ্ঞয়া উচ্যতে।'


এইসব  আশ্রয় প্রত্যেক মন্ত্রের শেষে  আসে। আচার্য সায়ণের ভাবার্থ অনুযায়ী এখানে যুষ্মদ্ 'ত্বা' শব্দ দ্বারা অভিপ্রায়  অস্তৃতমণিধারক পুরুষই।একে ত্রিব্ন্মণিও বলে। অত্যধিক প্রভাবশালী হওয়ায় জন্য এর এক নাম অস্তৃতমণিও।সায়ণ লিখেছেন যে ---হে মণি! প্রজার পালক সর্ব জগদ্ধিধাতা দেব সৃষ্টির প্রারম্ভেই তোমাকে অন্যদের থেকে অবাধিত মণি, অন্যকে দমন করার শক্তি পাওয়ার জন্য ধারণ করেন।হে মণিধারক পুরুষ!এমন মণির মধ্যে পুরোহিত,আয়ু,বর্চ ,ওজ এবং বল প্রাপ্ত করার জন্য তোমাকে বাঁধেন,এই অমৃতমণি তোমাকে রক্ষা করবে।


দয়ানন্দ বিচারধারার আলোকে --এখানে তিনটির বর্ণনা প্রতীত  হয়েছে।প্রজাপতির অস্তৃতের এবং যিনি বাঁধেন। প্রজাপতি -মাঙ্গলিক রাজা প্রতীত হয়েছে। প্রজাপতির  রাজ্যে দুটি শাসন প্রতিষ্ঠান আছে----সভা ও সমিতি। সভা তো লোকসভা এবং সমিতি হল--রাজ্যসভা অর্থাৎ প্রধান প্রধান প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সভা।


যথাঃ---- সভা চ মা সমিতিশ্চাবতাং প্রজাপতের্দুহিতরৌ সংবিধানে।য়েন সংগচ্ছা উপ মা স শিক্ষাধারু বদানি পিতরঃ সংগতেষু অথর্ব (৭/১২/১)।


সমিতি রাজ্যসভা।যথা---রাজানঃ সমিতাবিব যজু (১২/৮০)।অস্তৃতম্-এর অর্থ হলো--অপরাজিত অর্থাৎ যুদ্ধের মধ্যে যার হিংসা বা পরাজয় ছিল না--এমন মহাশাসক সম্রাট। যথা ---শাস ইত্ষা মহাঁ অস্যমিত্রসাহো অস্তৃতঃ। ন যস্য হন্যতে সখা ন জীয়তে কদা চন (অথর্ব ১/২০/৪)মন্ত্র 'অস্তৃতঃ'-কে 'মহান শাসঃ' অর্থাৎ মহাশাসক বলে। তথা এটাই বলা হয় যে,এর সখা না তো মারা যান , না কখনও পরাজিত হন। তিনি অমিত্রদের পরাজিত করেন।তাই এই মহারাজাদের সাথে রাজনৈতিক সন্ধির মধ্যে, মাঙ্গলিক রাজাদের বন্ধন আবশ্যক হয়ে যায়। 'অস্তৃতস্ত্বাভিরক্ষতু' দ্বারা এই কথাকে এবং বার বার সংকেত করা হয়েছে। বর্তমান সময়েও আত্মরক্ষার্থে রাজ্যের মধ্যে পারষ্পরিক সন্ধি হয়। রাজনৈতিক সন্ধি করেন যিনি ,সেই তৃতীয় ব্যক্তি,যিনি মাঙ্গলিক বা মহাশাসকের  রাজদূত।


(৫) বরণমণি:----


বরণমণির উল্লেখ অথর্ব ১০/৩ এর মধ্যে রয়েছে।এর উত্থানিকার মধ্যে আচার্য সায়ণ লিখেছেন যে,---- এই সূক্তের মধ্যে বরণ নামক মণির প্রতাপ বীর্য এবং শত্রু ক্ষয়ের শক্তি তথা ধারকের সব দুঃখের নাশের বর্ণনা এবং অভয়া নামক মহাশান্তির বরণমণি বন্ধনের মধ্যেও এই সূক্ত পড়ে যায়। সায়ণ ভাষ্য অনুসারে শত্রুক্ষয় ইত্যাদি চান যারা,এই সূক্ত দ্বারা দই ও মধু মিশিয়ে তিনরাত বসিয়ে বরণমণিকে সংপাতিত ও আমন্ত্রন করে বাঁধতে হবে।

দযানন্দীয় বৈদিক বিচারধারার মধ্যে প্রস্তুত সূক্তের মধ্যে 'বরণ'-এর বর্ণনা আছে। এর দুটি অর্থ সূক্তের মধ্যে সঙ্গত হয়েছে।

(১) শত্রু নিবারক সেনাধ্যক্ষ এবং

(২) রোগনিবারক বরণবনস্পতি। মন্ত্রের মধ্যে অবারয়ত্ন,অবীবরন্,বারয়িষ্যতে---দ্বারা 'বরণে'র অর্থ নিবারক প্রতীত হয়েছে।এই সূক্তের মধ্যে মণি দ্বারা সেনাধ্যক্ষরূপী রাজ্যরত্নের নির্দেশ হয়েছে। 

'जातै जातै युदत्कृष्टं तद्रत्नमित्यभिघीयते'

দ্বারা সেনার মধ্যে উৎকৃষ্ট সেনাধ্যক্ষের মণি অর্থাৎ রত্ন বলা হয়।

মণি ও রত্ন সমানার্থক । 'বরণ' ঔষধি বনস্পতির মধ্যে শ্রেষ্ঠ, অতএব মণি,রত্ন একই। মন্ত্র '১৭-এর মধ্যে 'বরণ' দ্বারা সেনাধ্যক্ষ তথা বরণ-ওষধের যুগবৎ বর্ণনা হয়েছে ।শেষ মন্ত্রতে কোথাও বরণ ওষুধ মূখ্যরূপ , কোথাও মূখ্যরূপেএর মধ্যে সেনাধ্যক্ষের বর্ণনা হয়েছে।এই সূক্তের মধ্যে ৯ থেকে ২৫ পর্যন্ত মন্ত্রের মধ্যে প্রায় বরণ দ্বারা সেনাধ্যক্ষের বর্ণনা সঙ্গত হয়েছে।


(৬)ফালমণি:----

 অথর্ব ১০/৬ -এর মধ্যে এই মণির উল্লেখ আছে। যাজ্ঞিক সম্প্রদানানুসার খাদির কাষ্ঠের ফালের বিকাররূপি মণিকে বাঁধার বর্ণনা এখানে আছে। শত্রুনাশ ও সব কামনাগুলির পূর্তির জন্যে এই মণিকে বাঁধার কারণে প্রস্তুত সূক্তের বিনিয়োগে আচার্য সায়ণ লিখেছেন যে,----

'खदिरकाष्टफालविकारं मणिं शत्रुनाशय सर्वकामावाप्तये बध्नाति।'


 পাশ্চাত্য বৈদিক বিদ্বানও এই মণিকে Amulet অর্থাৎ যাদু-টোনা রূপ মানেন।

উক্ত সূক্তের ৩৫ মন্ত্র আছে। স্বামী দয়ানন্দের বিচারধারার আলোকে 'ফালমণি'-র' অর্থ হলো ফাল থেকে উৎপন্ন মণি।=কৃষ্যত্র=,মঠা তথা  ঔষধি রস-----এটা পূর্ণ অন্ন। কৃষ্যত্র মণি,শ্রেষ্ঠ রত্ন রূপ।বন্যাত্র  অপেক্ষা কৃষ্যত্র শক্তিপ্রদানের শ্রেষ্ঠ, অতএব মণিরূপ।এই অন্ন মানুষকে রক্ষা করে, অতএব এটি কবচ।অন্ন ছাড়া মৃত্যু হয়ে যায়। পরন্তু কৃষ্যত্র তব পূর্ণ অন্ন হয়,যখন মঠে  এবং দুগ্ধরস তথা ঔষধিরসগুলি এর সাথে সহযোগ হয়,অন্যথা কেবল  কৃষ্যত্র অপূর্ণ অন্ন হয়।এই মিশ্রিত অন্নকে সেবন  দ্বারা বর্চস প্রাপ্ত হয়।


মন্ত্র ৩ এবং ৪ থেকে জানা যায় যে, ফাল 'খদির' কাষ্ট হয় ,যা ছুতোর তৈরি করে । সম্ভবত এই ফাল খৈর কাষ্ট দ্বারা নির্মিত করা হয়েছে।খৈর কারণ আর কাল হল কার্য।কার্য কারণের উপাচার। যথা 'অন্নং বৈ প্রাণীনাং প্রাণঃ'---প্রাণ কার্য এবং অন্ন হলো কারণ । অতএব প্রাণকে অন্ন বলা হয়।এই প্রকারে ফালকে খদির বলা হয়।

মন্ত্র দুটির মধ্যে ফাল দ্বারা উৎপন্ন কৃষ্যত্র  মণি বলে ফাল এবং কৃষ্যত্র মণিও কারণ কার্যভাব। অথবা সাধন ও সাধ্যভাব।এক জাতির পদার্থের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ পদার্থ মণি বলা হয়েছে। অন্নের মধ্যে কৃষ্যত্ব শ্রেষ্ঠ,তাই কৃষ্যত্ব মণি,রত্ন।কৃষ্যত্র দ্বারা গরু এর চারণ মিলে, এবং সেই গরুগুলি থেকে দুধ ও দুধ থেকে ঘৃত পাওয়া যায়। তাই কৃষ্যত্রের ৬ মধ্যে 'ঘৃতশ্চুত' বলা আছে।কৃষ্যত্রের সেবন দ্বারা শরীর ও মনে বল ও উগ্ৰতা উৎপন্ন হয়। বৃহস্পতি যখন কৃষত্রের পরিণাম  'বীর্য '-কে নিজ শরীরে বেঁধে রাখতে চায় এবং বিষয়লম্পট হয়ে তার বিনাশ না করে তাহলে ঔজকে প্রাপ্ত করতে হবে।(ওজসে)' অবধ্নাত্' দ্বারা মণিকে বাঁধার সূত্র বা সূতোদ্বারা অভিপ্রেত হতো না,যেখানে আচার্য সায়ণ লিখেছেন।কিন্তু এই শরীরকে স্থির রাখায় অভিপ্রেত --যেমন 'দেশবন্ধঃ চিত্তস্য ধারণা'(যোগদর্শন৩/১) --এতে চিত্তকে ধ্যেয়-এর মাধ্যমে বাঁধার বর্ণনা আছে।ধ্যেয়-এর সাথে চিত্তকে সূত্র দ্বারা বাঁধা যায়না । ধ্যেয়-এর মাধ্যমে চিত্তকে স্থির করা ,এটাই অভিপ্রায় ।


সূক্তোক্ত বিভিন্ন মন্ত্রগুলির দ্বারা  এমন জ্ঞান হয় যে,এই মণি সূর্য,চন্দ্রমা,অন্তর্দেশ,প্রদিশঃ,দেবতা,শত্রু,মাস,মাসসমূহ,সংবত্সর,আপঃ ইত্যাদি জড় পদার্থ ধারণ করে (বাঁধতে হে)। অতএব মণিবন্ধনের যে অর্থ যাজ্ঞিক সম্প্রদায়ানুসার করেছে,তা সমুচিত প্রতীত নয়।এ দ্বারা জ্ঞাত হয় যে, এই মণি খদির বা খদির ফাল  দ্বারা উৎপন্ন স্থুলমণি নয়,যাকে সূর্য আদি ধারণ করে। সূর্য আদি মণি সম্বন্ধী  মণিগুলি কি? একে প্রফেসর বিশ্বনাথ বিদ্যালঙ্কার ইত্যাদির ভাষ্যগুলির মধ্যে দেখা যেতে পারে। পরমেশ্বরও সৃষ্টঘৃত্পাদনের জন্য মণিকে বাঁধেন,তাই ---यह मणि सृष्टि के उत्पादन में परमेश्वरीय कामनारूप है,न कि कोई प्राकृतिक मणि ( मं ९/१७)।


এই সূক্তের মন্ত্রে ২১ থেকে২৮ এবং ৩১ থেকে ৩২ -থেকে এসেছে-----


(১) সবাইকে ধারণ- পোষণকারী পরমেশ্বরও মণিকে ভূত-ভৌতিক বিবিধ পদার্থগুলির রচণার জন্য বাঁধেন, কেননা পরমেশ্বরের কি কোনো শরীর আছে, যার অবয়বের উপর স্থুল মণি বাঁধা যেতে পারে।

(২) এই মণি অসুরদের অসূরকর্মের ( অসুরক্ষিতি) ক্ষয়কারী হয়।


(৩) পরমেশ্বররূপী মণি,যখন মাথায় আরোহন করে, তখন মনুষ্য মাথা থেকে  পা পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ হয়ে যান।


(৭) দর্ভমণি:------- অথর্ববেদ কাণ্ড১৯  সূক্ত ২৮ থেকে ৩০ ও ৩২,৩৩ কুল পাঁচ সূক্তের ৩৯ মন্ত্রতে দর্ভমণির বর্ণনা আছে।যাজ্ঞিক মন্ত্রদায়ানুসারে কান্ড১৯ এর ২৮,৩০ সূক্তে ঐন্দ্রো নামক মহাশান্তির দর্ভমণিবন্ধন এবং ৩২ থেকে ৩৩ সূক্তের য়াম্যা মহাশান্তির দর্ভমণি বন্ধনের মধ্যে বিনিয়োগ হয়েছে। আচার্য সায়ণ লিখেছেন যে-----


'इमं वध्नामि ते मणिम्' इति सूक्तत्रयम्------ऐनद्रूयाख्यायां महाशान्तै दर्भमणिवन्धने विनियुक्तम्। 'शतकाण्डो वृश्च्यवनः' इत्यादिकं षष्ठं सूक्तम्। तस्य याम्यां यमभये  (न.क.१७) इति विहितायां याम्याख्यायां महाशान्तौदर्भमणिवन्धनं कुर्यात्।


আচার্য সায়ণ এর বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লিখেছেন যে,এই কুশা (দর্ভ) থেকে নির্মিত মণি। আর্য ভাষাভাষ্যের অনুসারে দর্ভ শব্দের ব্যুৎপত্তি এই প্রকার দৃ বিদারণে ( দর্) ভা দীপ্তৌ (ভম্)।আতোऽনুপসর্গে কঃ অষ্টা  (৩/২/৩)। যার অর্থ হলো শত্রুদেরকে বিদারণ দ্বারা  প্রদীপ্তকারী।মণি=সেনাপতিদের মধ্যে শিরোমণি রূপ। দৃণাতি 'বিদারয়তীতি দর্ভ দর্ভ' ( উষ্ণ ৩/১৫১)= শত্রুর বিদারণের কারণে সেনাপতিকে দর্ভ বলা হয়।দর্ভঙ্করের অগ্ৰভাগ কণ্টকময় হয় , যে ফলকে বিদারণ করে দেয়। এই প্রকার রূপক দৃষ্টি থেকেও সেনাপতিকে দর্ভ বলা যেতে পারে । যেমন  বাহাদুরকে 'শের'  আর  নির্বুদ্ধিকে  গাধা বলা হয়। সূক্ত ২৯ এর মন্ত্র ০১  থেকে ০৪ পর্যন্ত সাম উপায়ের বর্ণনা আছে  এবং মন্ত্র ৫ থেকে ৯  পর্যন্ত দণ্ড-উপায় বলা হয়েছে । শত্রুকে  নিজ অনুকূল করার চারটি উপায় আছে ---সাম,দান,দণ্ড ও ভেদ। সামের অভিপ্রায় হলো----শান্তি,সমঝোতা,পরস্পর বার্তালাপ তথা সন্ধি ইত্যাদি শান্ত উপায়গুলির বর্ণনা।


অথর্ব ১৯/২৮-৩০ তিন সূক্তের মধ্যে দয়াননন্দীয় বিচারধারা  থেকে 'শত্রু বিদারক সেনাপতি' -কে দর্ভমণি নাম দেওয়া হয়েছে । এই জন্য  কিছু নিম্নলিখিত বিশেষণ আছে যা উক্ত সূক্ত থেকে এসেছে------


১| সপত্নদম্ভনম্-আন্তরিক শত্রুদের দমনকারী।


২| দ্বিষতস্তপনং হৃদঃ- দ্বেষী রাজার হৃদয়কে উৎপীড়নকারী।

 

৩| শত্রুণাং তাপয়ন্ মনঃ- শত্রুদের মনকে উৎপীড়নকারী।


৪| ধর্ম ইব -  গীষ্ম ঋতুর সূর্য সদৃশ সংতপ্তকারী।


৫|  দুর্হার্দান্ - দুষ্ট হার্দিক ভাবনাগুলিকে হননকারী।


৬। তনুপানম্-শরীরের রক্ষক।


উপর্যুক্ত কতিপয় বিশেষণ আচার্য সায়ণ নির্দিষ্ট 'কুশা'( দর্ভ) থেকে নির্মিত মণি- র উপর ঘটতে পারে না।সূক্ত ২৮- এর প্রথম মন্ত্রে প্রজাজনের প্রতিনিধি বলার মধ্যে উপর্যুক্ত বিশেষণগুলি থেকে যুক্ত সেনাপতি (দর্ভমণি) কে তার সাথে দৃঢ়বদ্ধ করে (বধ্নামি)।


ভিদ্ধি= ভিন্ন - ভিন্ন (বিভেদ ) করা , ছিদ্ধি= ছিন্ন-ছিন্ন করা, বৃশ্চ=কেটে ফেলা,পিশ= টুকরো টুকরো করা,বিদ্ধ= টুকরো টুকরো করে ফেলা,নিক্ষ= বেঁধে ফেলা, তৃদ্ধি= ক্ষীণ করা,রূদ্ধি= অনাদর করা,মৃণ=ঘিরে ফেলা,মন্থ= প্রাণদণ্ড দেওয়া,পিঙি্ঢ= প্রাণদণ্ড দেওয়া,ওষ-মেরে ফেলা,দহ= সুলসা দেওয়া,দগ্ধকরা,জহি= হনন করা ---ইত্যাদি এই  লোক লকার মধ্যমপুরুষ একবচনের ক্রিয়াগুলির প্রয়োগ শত্রুবিদারক সেনাপতি র সাথে হয়েছে, সায়ণ নির্দিষ্ট তথাকথিত দর্ভনির্মিত মণির সাথে হয়নি।

এইভাবেই এই ক্রিয়াগুলির সার্থকতা চেতন পুরুষের সাথেই   ঘটতে পারে।


त्वं राष्ट्राणि रक्षसि (१९/३०/३)

তুমি রাষ্ট্রের রক্ষা করো---এই মন্ত্রাংশ 'দর্ভ নির্মিত মণি'-র সাথে উপপত্র হবে?এটা তো  শত্রুদের বিদারণকারী শিরোমণিরূপ সেনাপতির উপরই ঘটতে পারে।

অথর্ব ১৯/৩২-৩৩ সূক্তের মধ্যে পরমাত্মার অবিদ্যাগন্থি বিদারক-রাগদ্বেষবিদারক এবং ভয়বিদারক বলা হয়েছে।এটা এই দুটি সূক্তের মধ্যে 'দর্ভমণি'-র আধ্যাত্মিক অর্থ রয়েছে। দর্ভ= বিদারয়তি অবিদ্যা গ্ৰন্থিম্। ঔষধি (১৯/৩২/১)- ঔষদ্ধয়তি দোষং ধয়তীতি বা (নি.৯/৩/২৩) পরমেশ্বর অবিদ্যাদি রোগগুলির ঔষধ রূপ,উগ্ৰ ঔষধরূপ । আচার্য সায়ণ ১৯/৩২ সমগ্ৰ সূক্তে দর্ভকে কুশা ঘাসের বর্ণনা করেছেন।যেখানে 'দর্ভ' কুশা ঘাস নয়। তিনি তো অবিদ্যাগ্ৰন্থিবিদারক পরমেশ্বরের (দর্ভ) -উপর উপপত্র হতে পারেন।

পুরো মন্ত্র এই প্রকার------


यो जायमानः पृथिवीमदंहद् यो अस्तभ्नदन्तरिक्षं दिवं च।

यं विभं ननु पाप्मा विवेद सनोऽयं दर्मो वरुणो दिवा कः।। 


উপর্যুক্ত মন্ত্রতে

 ১|পৃথিবীমদংহদ্---যিনি পৃথিবীকে দৃঢ় করেন।

২|  অন্তরিক্ষং দিবং চ অস্তভ্নাত্অন্তরিক্ষম---আর দ্যূলোককে যিনি থামান।

৩| দিবা কঃ---জ্ঞানপ্রকাশকারী এই বিশেষণ কুশার উপর ঘটতে পারে না, কিন্তু পরমাত্মার উপর ঘটতে পারে। বেদের মধ্যে অন্যত্রও এমন কথা পরমাত্মার উদ্দেশ্যে আসে,যেমন --যেন দৌরুগ্ৰা পৃথিবী চ দৃঢ়া (যজু.৩২/৬)।


উপসংহার:-------


আমরা উপরের পংক্তিগুলির মধ্যে প্রার সব মণিসূক্তের সমীক্ষা প্রস্তুত করেছি। আমরা কোনো যাদু-বিদ্যা-র  (Amulet)শক্তি রক্ষাকারী মণিবিশেষের বর্ণনা করিনি।আমরা এখানে গুণযুক্ত ঔষধিগুলির বর্ণনা করেছি,যেখানে রোগ নিবারণের অনেক উপযোগী কারণ মূল্যবান মণি বলে দেওয়া হয়েছে,সেখানে রাষ্ট্ররোগ ক্ষুধা,পিপাসা , হিংসা ইত্যাদির নিবারণ মণিরূপ সেনাপতি ঔষধি ইত্যাদিরও বর্ণনা হয়েছে।এই প্রকার গম্ভীর অধ্যয়ণ,মনন,চিন্তন, অনুসন্ধান করার পর সব মণিসূক্তের  আয়ুর্বেদপরক এবং রাজনীতি পরক সুন্দর ব্যাক্ষা হতে পারে।যেখানে কিছু মণিসূক্তের উপর্যুক্ত উভয়দিধ ব্যাক্ষা সম্ভব,  সেখানে 'দর্ভমণি'-র আধ্যাত্মিক (অবিদ্যাগ্ৰন্থনিবারক পরমেশ্বর) ব্যাক্ষাও আছে।


তপতী শাসমল


......................০....…..........