रविवार, 16 अप्रैल 2023

গুরুকূল শোধ ভারতী-জয়া সেন

 পৃ:-৯৫ 


ঋগ্বেদের পরিপ্রেক্ষিতে সঙ্গীত


বেদ হলো অক্ষয় বিচারসমূহের মানসসরোবর যেখানে বিচারধারা অবিচ্ছিন্নভাবে প্রবাহিত হয়ে ভারতভূমির মস্তিষ্ককে উর্বর করে নিজের সত্তার জন্য সেই উদগম ভূমিতে অবলম্বিত করে। এটি শুধু ভারতীয় সাহিত্যের সর্বপ্রথম গ্রন্থ নয়, বরং মানবমাত্রই ইতিহাসে এর চাইতে প্রাচীন গ্রন্থ এখনো অবধি পাওয়া যায়নি।২ বেদে আমাদের জীবন সম্বন্ধিত সমস্ত ক্রিয়াকলাপের অন্তর্ভাব রয়েছে।৩ এজন্য আচার্য মনু বলেন, "বেদোঽখিলো ধর্মমূলম।"৪ ঋক্, যজু, সাম ও অথর্ব শ্রেণীবিভাগে এই চার প্রকার। এদের সংহিতাও বলা হয়। মন্ত্রসমূহকেই একত্রে সংহিতা বলে। বৈদিক সাহিত্যের দুটি প্রমুখ বিভাগ রয়েছে। সংহিতা ও ব্রাহ্মণ। ৬ সঙ্গীতও জ্ঞানরুপী গঙ্গার একটি ধারা। এজন্য বলা হয়েছে যে ছন্দবদ্ধ মন্ত্রই ঋক্।৮ এই ঋচাসমূহের উপরেই গান নিবদ্ধ,এদের সংজ্ঞাই সাম।৯ ঋক্ ও সাম ব্যতীত বাকি মন্ত্রকে যজুষ্ বলা হয়।১০


সঙ্গীত রত্নাকরদের মধ্যে শার্গদেব সঙ্গীতকে পরিভাষিত করে লিখেছেন যে, গীত,বাদ্য এবং নৃত্য এই তিনটির অন্বিত স্বরুপই সঙ্গীত।১১ আচার্য কৌটিল্যও গীত-বাদ্য এবং নৃত্যের উল্লেখ সহচরী কলারুপে নিজের গ্রন্থ অর্থশাস্ত্রে উল্লেখ করেছেন। ১২ আচার্য ভরতমুনিও গীতকে নাটকের প্রমুখ অঙ্গের মধ্যে অন্যতম বলে মনে করেন তথা বাদন ও নৃত্যকে এর অনুগামী বলেছেন।১৩ ব্যাকরণাত্মক দিকে সঙ্গীত শব্দ সম্ উপসর্গ পূর্বক √গৈ ধাতু দ্বারা ক্ত প্রত্যয়ের যোগে নিষ্পন্ন মান্য করা হয়েছে। যার ব্যুৎপত্তিগত 

অর্থ হলো- সম্যক রুপেণ গীতম্ অর্থাৎ ভালোভাবে গাওয়া। ১৪

--------------------


১. শোধ ছাত্রা, নৃত্য এবং সঙ্গীত বিভাগ, কুরুক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয়, কুরুক্ষেত্র।

২. আচার্য বলদেব উপাধ্যায়, ভারতীয় দর্শন, পৃ০সং০-২৭

৩. চাতুর্বণ্যং ত্রয়ো লোকাশ্চত্বারশ্চাশ্রমাঃ পৃথক্। ভূতং ভব্যং ভবিষং চ সর্বং বেদাৎ প্রসিধ্যতি। মনুস্মৃতু-১২/৯৭

৪. মনুস্মৃতি-২/৬

৬. মন্ত্রব্রাহ্মণয়োর্বেদনামধেয়ম্ যজ্ঞপরিভাষা-৩১

৮. তেষামৃগ্ যত্রার্থবশেন পাদব্যবস্থা জৈ০ সূ০ - ২/১/৩৫

৯.জৈ০ সূ০ ২/১/৩৬

১০. শেষে যজুঃ শব্দঃ। জৈ০ সূ০- ২/১/৩৭

১১. গীতং বাদ্যং তথা নৃত্যং ত্রয়ং সঙ্গীতমুচ্যতে।।- সঙ্গীতরত্নাকর-১/২১

১২. আচার্য কৌটিল্য, অর্থশাস্ত্র,২/২৭

১৩. আচার্য ভরতমুনি, নাট্যশাস্ত্র, অ০ ৪/২৬০/২৬৫








পৃ:৯৬




এইভাবে চৌষট্টি কলাসমূহের মধ্যে এক সঙ্গীতকলা কে ঋচাসমূহের কালরুপে মান্য করা হয়। ঋগ্বেদ সংহিতায় এর প্রমাণসমূহকে নিম্নলিখিত রুপে অভিব্যক্ত করা যায়-


ঋগ্বেদে সঙ্গীত


ঋগ্বেদে সঙ্গীতের পর্যাপ্ত প্রচলন দৃষ্টিগোচর হয়। শাংখায়ন ব্রাহ্মণে গীত, বাদ্য এবং নৃত্যের প্রয়োগ অভিন্ন সাহচর্য রুপে পাওয়া যায়। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ অনুসারে এই শিল্পত্রয়ের গণনা দেবী শিল্পসমূহেও করা হয়।১৬ ঋগ্বেদ সংহিতায় গীতের জন্য গীর, গাথা, গায়ত্র ১৭ গীতি তথা সাম আদি শব্দের প্রয়োগ পাওয়া যায় তথা গায়কের জন্য গাতুবিত্তম্ শব্দের উল্লেখও পাওয়া যায়।১৮ ঋগ্বেদে সঙ্গীতের গুরুশিষ্য পরম্পরারও এক স্থানে বর্ণনা পাওয়া যায় যেখানে গুরু শিষ্যকে বলেন, হে শিষ্য! তুমি নিজের আত্মিক উত্থানার্থে আমার কাছে এসেছো, আমি তোমায় ঈশ্বর প্রাপ্তির উপায় বলছি।১৯ সঙ্গীতও ঈশ্বর প্রাপ্তির একটি সাধনা। ঋগ্বেদে সুপ্রসিদ্ধ বাদ্যবাণ অথবা বাণের বর্ণনা পাওয়া যায়। বীণা শব্দের উল্লেখ কোথাও পাওয়া যায় না। আচার্য সায়ণের মতে বাণ শব্দের অর্থ তীরযুক্ত বীণা।২০



যেভাবে আধুনিক সঙ্গীতে বৈচিত্র‍্য আনার জন্য গানকে পঙ্কত্তি তথা পদসমূহের গান অনেকবার বিবিধ স্বরের সাথে গাওয়া হয় সেভাবে বৈদিক সঙ্গীতে এরুপ গান স্তোম নামে প্রসিদ্ধ ছিল।২১ ঋগ্বেদে গাথাসমূহের গায়ককে গাথিন বলা হয়েছে।২২ গায়ত্রিন্ শব্দও গায়ক হিসেবেই পাওয়া যায়।২৩ পুরুষসূক্তে ঋক্ তথা সামকে পরমেশ্বরের আদিম সৃষ্টি হিসেবে মানা হয়েছে।২৪ সামসমূহের আধারেই ঋচাসমূহের গান হয়। এই সামগান সেই বিদ্বানসমূহের লাভ হয় যারা অধ্যবসায়ী এবং জাগরণশীল হয়।২৫ সামের গান দ্বারা সম্পূর্ণ নভোমণ্ডল প্রতিধ্বনিত হয়।২৬ ঋগ্বেদে পাখিদের কূজনের উপমা সামগান হিসেবে দেওয়া হয়েছে। ২৭ ঋগ্বেদে সামসমূহের আবিষ্কারক

–------------------------------------

১৪. ডাঃ ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা, পারিজাত কোশ, পৃ০ সং০-৯৯৫

১৫. ত্রিবৃদ্বৈ শিল্পং নৃত্যং গীতং বাদিতমিতি, শাংখায়ন ব্রাহ্মণ-২৯/৫

১৬. এতদ্ধি দিব্যং শিল্পং ন মানুষম্। - কথাসরিৎসাগর এ উদ্ধৃত এ০ বা০ ২৫/১৭৫

১৭. স নঃ স্ববান আ ভর গায়ত্রেণ নবীয়সা। ঋ০ বে০-১/১২/২২

১৮. ঋগ্বেদ- ৩/৬২/১৩, ৯/১০৪/৫

১৯. ঋগ্বেদ, -৮/৩৩/২

২০. ঋগ্বেদ,- ১/৮৫/১০, সায়ণ ভাষ্যমতে।

২১. নিরুক্ত নৈগমকাণ্ড-২/১১

২২. ঋগ্বেদ,-১/৭/১

২৩. ঋগ্বেদ,-১/১০/১

২৪. তস্মাদ্যজ্ঞাৎসর্বহুত ঋচঃ সামানি জজ্ঞিরে। ঋ০বে০ - ১০/৯০/৯

২৫. যো তং জাগার ঋচঃ কাময়ন্তে যো জাগার তমু সামানি যন্তি। ঋ০ বে০ ৫/৪৪/৪

২৬. গায়ন্ সাম নমন্যং যথা বেঃ,- ঋ০বে০-১/১৭৩/১

২৭. উদ্গাতেব শকুনে সাম গায়সি ব্রহ্মসূত্র এব সবনেষু শংসসি। ঋ০বে০- ২/৪৩/২











পৃ:-৯৭



আচার্যদের মধ্যে অঙ্গিরস,২৮ ভরদ্বাজ২৯ তথা বশিষ্ঠের৩০ উল্লেখ রয়েছে। কিছু বিশিষ্ট ছন্দের নামে সাম প্রসিদ্ধ হত যেখানে গায়ত্র তথা শার সাম এই শ্রেণীরই অন্তর্ভুক্ত৩১। এছাড়াও রৈবত, বৈরুপ, অর্ক, ভদ্র আদি সামেরও উল্লেখ পাওয়া যায়। ঋগ্বেদে অন্ত্যেষ্টির সময় সামগানের স্পষ্ট বিধান রয়েছে।৩২


ঋগ্বেদে অনেক বাদ্যের প্রচুর উল্লেখ পাওয়া যায়, যথা দুন্দুভি, বাণ, নাড়ী, বেণু, কর্করি, গর্গর, গোধা, পিঙ্গ তথা আঘাটি। দুন্দুভির উল্লেখ তো ঋগ্বেদের অনেক জায়গায় পাওয়া যায়।৩৩ বাণ বাদ্যের বাদন পবমান সোমের প্রীত্যর্থ করে যাওয়ার উল্লেখও এখানে পাওয়া যায়।৩৪ বাণ বাজিয়ে পরাক্রম দেখানোর উল্লেখও রয়েছে।৩৫ এর মাধ্যমে সপ্ত তন্দ্রিয়ের সংকেতও পাওয়া যায়।৩৬ এছাড়াও কংকরি, গর্গর,৩৭ ক্ষোণী আদি বাদ্যের উল্লেখও ঋগ্বেদে পাওয়া যায়।৩৮ ঐতরেয় আরণ্যকে দৈবী এবং মানুষী বীণার অত্যন্ত রমণীয় সামঞ্জস্য দেখা যায়।৩৯


গীত তথা বাদ্যযন্ত্রের সাথে নৃত্যের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ রয়েছে। ঋগ্বেদে সামূহিক নৃত্য দ্বারা উত্থিত ধূলির উল্লেখ পাওয়া যায়।৪০ যেখানে নারীরাও অংশগ্রহণ করত। ঋগ্বেদের এক স্থানে বিবিধ গীতক্রমে যুক্ত লোকনৃত্যের উল্লেখও পাওয়া যায়।৪১ ঐতরেয় আরণ্যকে নৃত্যের বিষয়ে বর্ণনা পাওয়া যায় যে মহাব্রত নামক সোমযাগে দাসীদের সমূহ নৃত্য আয়োজিত হত, যেখানে কমপক্ষে তিনজন বা বড়জোর ছয়জন নর্তকী থাকত, প্রত্যেক নর্তকী মাথায় জলভরা ছোট পাত্র ধারণ করে বাম থেকে ডান দিকে বর্তুলাকার গতিতে নৃত্য প্রদর্শন করত। নৃত্যের পদক্ষেপ গীতের সাথেই শুরু হতো।৪২ বিবাহের পর বধূকে দিয়ে গান গাওয়ানোর উল্লেখ শাংখায়ন গৃহ্যসূত্রের অনেক জায়গায় পাওয়া যায়। ৪৪

–---------------------------------

২৮. দেবাঃ অঙ্গিরসাং সামভিঃ স্তুয়মানাঃ ভরদ্বাজো.......ঋ০বে০ ১/১০৭/২

২৯. ঋ০বে০-১০/১৭১/১

৩০. ঋ০বে০-৭/৩৩/৪,১০/৭১/১১

৩১. ঋ০বে০-১০/১৩৫/৪

৩২. ঋ০বে০-১/২৮/৫, ৭/৫১/১

৩৩. ঋ০বে০- ৭/৯৭/৮

৩৪.ঋ০বে০-১/৮৫/১০

৩৫. ঋ০বে০-১০/৩২/৪

৩৬. ঋ০বে০-২/৪৩/৩

৩৭. ঋ০বে০-১/১১৭/৮

৩৮. ঐতরেয় আরণ্যক-৩/৩৫

৩৯. ঋ০বে০-৭/৬৩/১

৪০. ঋ০বে০-১০/১৮/৩

৪১. ঐ০আ০-১/১

৪২. শাংখায়ন গৃহ্যসূত্র-১/১১/৫











পৃ:-৯৮




নিষ্কর্ষ রুপে এটা বলা যায় যে, ভারতীয় সঙ্গীতের আদি গ্রন্থ ঋগ্বেদ, কারণ এখানে বর্ণিত উদাত্ত, অনুদাত্ত এবং স্বরিত নামক তিন স্বর৪৫ থেকে সপ্তক৪৬ হয়েছে যার উপর বর্তমান সঙ্গীত প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। এভাবে গীত, বাদ্য এবং নৃত্যের সমভাবাপন্ন সঙ্গীতের বর্ণন প্রাণীমাত্রের আদিগ্রন্থ ঋগ্বেদে বীজরুপে বৃদ্ধিকে প্রাপ্ত হয়েছে বলে মনে করা হয়।



–--------------------------------



৪৪.শাং০ গৃ০ ৭ ১/২২/১৬

৪৫. মহাভাষ্য ১/২/২৯





[পৃ:- (৯৫-৯৮) সমাপ্ত]










পৃঃ- ১০৫-


মানবের প্রত্যেক কাজ এবং ব্যবহারের মূলে জন্মজাত এবং অর্জিত প্রবৃত্তিসমূহ লুকিয়ে থাকে, যা তার ব্যবহারকে প্রেরণা দেয়। ভারতীয় মনিষীরা মুখ্য পুরুষার্থের ধর্ম, অর্থ এবং কাম কে মানব ব্যবহারের মুখ্য প্রেরক তত্ত্ব মেনেছেন। যার প্রাপ্তি তথা সিদ্ধির জন্য মানব বিভিন্ন ধার্মিক বা সামাজিক কাজ সম্পন্ন করে। "ফ্রায়ড" নামক মনোবিজ্ঞানী সেই তথ্যসমূহকে স্বীকার করে বলেছেন যে মানব ব্যবহারের মূলে পুত্রৈষণা, বিত্তৈষণা তথা লোকৈষণা প্রত্যেক শক্তিরুপে কাজ করে। যা বৃষ্টির বন্যার ন্যায় ব্যক্তির ভেতর শক্তিশালী হয়, যার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মানুষও যেকোনো কাজ বা অনুষ্ঠান করে। সব মনোবিজ্ঞানী মনের ইচ্ছাশক্তি রাগকেই সম্পূর্ণ সৃষ্টির মূল প্রেরক তত্ত্ব রুপে স্বীকার করেছেন।


পারস্কর প্রতিদিন অনুষ্ঠান করার কথা বলেছেন১০ যেখানে অনেক কাজ থাকে। যেসবের নিজ মনোবৈজ্ঞানিকতা রয়েছে। যেসবের উদ্দেশ্য মানুষকে এক উদ্দেশ্যপূর্ণ জীবন প্রদান করা ছিল। বৈদিক যজ্ঞানুষ্ঠানে প্রযুক্ত ক্রিয়াসমূহ প্রোক্ষণ, সংকল্প, উপবাস, স্তুতিসমূহ, দীক্ষা, যজ্ঞোপবীত আদি মনোবৈজ্ঞানিক তথ্যসমূহ দ্বারা পরিপূর্ণ।


ভারতীয় সভ্যতা অনুসারে যজ্ঞোপবীত ধারণ করাকে এক অনিবার্য কর্তব্য হিসেবে মান্য করা হয়েছে।১১ প্রত্যেক তিন সূত্র সত্ত্ব, রজ এবং তম তিন গুণের পরিচায়ক। কোথাও একে ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশের পরিচায়ক হিসেবে মান্য করা হয়েছে। এর তিন গিটকে অদ্বৈতগ্রন্থি বানিয়ে বাম কাঁধ থেকে কোমর পর্যন্ত ধারণ করলে চিত্তের শুদ্ধি হয়। কোথাও আবার ক্ষিতি, জল এবং পাবক নামক তিন তত্ত্বের প্রতিনিধিত্ব করে। মানুষকে সংস্কারিত করার জন্য যজ্ঞানুষ্ঠানে পূর্ব যজ্ঞোপবীতকে ধারণ করা আবশ্যক তবেই ব্যক্তি "বসুধৈব কুটুম্বকম" এর ভাবনায় যুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ বিশ্বের মঙ্গলের জন্য কাজ করে।


যজ্ঞানুষ্ঠানসমূহকে সম্পন্ন করতে উপবাসের বিশেষ বিধান রয়েছে, কারণ উপবাসকালীন সাধকের আত্মিক শক্তিসমূহ জাগ্রত, চৈতন্য এবং তীব্র হয়ে যায়, যার দ্বারা বিচারসমূহের নবোত্থান হয়, বিবেক বুদ্ধির বিকাশ হয়। যা মানবের মলিন ইচ্ছাসমূহ দমন করে অন্যদের উত্থানের ভাবনা জাগ্রত করে।


যজ্ঞানুষ্ঠানের সময় জল দ্বারা প্রোক্ষণ করা হয়। জলের স্বভাবই হলো মলিনতাকে ধোয়া এবং দুই বস্তুকে পরস্পর সংযুক্ত করা। মানুষের সময়ে সময়ে অসত্য বলার জন্য তার অন্ত:করণে মলিনতা আসে। এই মলিনতা ধোয়ার জন্যই প্রোক্ষণের প্রয়োজন হয়। যার দ্বারা শুদ্ধ অন্ত:করণকারী ব্যক্তির মধ্যে নতুন সংস্কার দৃঢ়তার সাথে স্থির থাকতে পারে।

স্নান, সন্ধ্যা, দান, দেবপূজন তথা যেকোনো প্রকার সৎকর্মের শুরুতে সংকল্প করা আবশ্যক। অন্যথা সব কর্ম নিষ্ফল হয়ে যায়। সংকল্প এক এরুপ মানসিক শক্তি যা অসম্ভব কার্যকে সম্ভব করে তোলে। তাই

-------------------------------------

৯. পারস্কর গৃহ্যসূত্র ২/৯/১৬

১০. মনোবৈজ্ঞানিক jyonsh এবং সিম্পসন অনুসারে, - "প্রেরণা এক প্রক্রিয়া, যার মধ্যে শিক্ষার্থীর আত্মিক শক্তিসমূহ যা



১১.পারস্কর গৃহ্যসূত্র ২/২/১১

১২.








পৃঃ ১০৬



প্রসিদ্ধ মনোবৈজ্ঞানিক কাণ্ট সংকল্পকে তৃতীয় মানসিক শক্তি মেনেছেন।


বৈদিক আর্য যজ্ঞানুষ্ঠানের সময় সত্য, শ্রদ্ধা এবং পবিত্রতা দ্বারা পরিপূর্ণ ঈশ্বর থেকে নিজের সুখ-সমৃদ্ধির কামনায় স্তুতি করত যার দ্বারা তিনি প্রসন্ন হয়ে তার মনস্কামনা পূরণ করতেন। ঋগ্বেদের এক স্থানে এই স্তুতিসমূহকে পবিত্র বচন বলা হয়েছে।১৩ মানব জীবন এই পবিত্র বচনসমূহ দ্বারা জাগ্রত যজ্ঞানুষ্ঠানসমূহ দ্বারা সেইরুপে বিকশিত বা সমৃদ্ধ হত, যেরুপে বৃক্ষের অংকুরকে বৃদ্ধি করানোর জন্য মালী অনেক কাজ করে।


বৈদিক দীক্ষা এবং দক্ষতার সম্পর্ক মানুষের মানসিক উৎকর্ষ এবং উদাত্ত চরিত্রের সাথে রয়েছে। দীক্ষা দ্বারা দক্ষ ব্যক্তি মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করে আত্মিক উৎকর্ষতার সেই উচ্চ শিখরে পৌছায়, যেখানে চারদিকে সব কল্যাণই কল্যাণ।


ঋগ্বেদে বিবিধ প্রকারের দান এবং দাতাদের প্রশস্তি গাওয়া হয়েছে।১৪ গাভীদের দান করা ব্যক্তি স্বর্গে উচ্চস্থান লাভ করে। অশ্ব দানকারী ব্যক্তি সূর্যলোকে নিবাস করে। স্বর্ণ দানকারী ব্যক্তি দেবতা হয়। পরিধান দানকর্তা দীর্ঘ জীবন লাভ করে।১৫ তৈত্তিরীয় সংহিতায় সর্বস্ব দানকেই ব্যক্তির তপস্যা বলা হয়েছে।১৬ বৈদিক অনুষ্ঠানে প্রযুক্ত সামগ্রীসমূহও বৈজ্ঞানিক এবং মনোবৈজ্ঞানিক তথ্য দ্বারা পরিপূর্ণ। 


মনুষ্য কৃত বিভিন্ন যজ্ঞানুষ্ঠানসমূহের পেছনে স্বর্গ প্রাপ্তি, ধন-ধান্যের বৃদ্ধি, চারিত্রিক শুদ্ধি সবকিছুর মধ্যে শ্রেষ্ঠতর হওয়া এবং সম্পূর্ণ কামনাসমূহের সিদ্ধি আদি ভাবনাসমূহ সমাহিত থাকে, যার দ্বারা প্রেরিত হয়ে সে সময়-সময়ে প্রয়োজন অনুসারে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে থাকে।


বেদকালীন গ্রামীণ লোকদের জীবিকা উপার্জনের প্রমুখ সাধন কৃষি ছিল। নিজের ফসলের রক্ষার্থে তারা বিভিন্ন প্রকারের যজ্ঞের আয়োজন করত। যার মধ্যে তারা বৈদিক দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করে তাদের প্রসন্ন করতে পারে এবং তারা যেন তাদের ফসল রক্ষা করে। সেখানে নতুন অন্নের আহুতি দেওয়া হতো। যার উদ্দেশ্য ছিল প্রসন্নচিত্ত দেবতা অতিবৃষ্টি তথা অনাবৃষ্টিতে তাদের ফসলকে রক্ষা করে ভবিষ্যতে তাদের ধন-ধান্যে পূর্ণ করে।


মানুষকে খারাপ কাজ থেকে রক্ষা করার জন্য, চরিত্রকে শুদ্ধ তথা দৃঢ় নিশ্চয়ী করার জন্য যাগের ব্যবস্থা করা হত। "সৌত্রামণী যাগ" এর আয়োজন এই উদ্দেশ্যপূরণ হেতু করা হতো। সূত্রাৎ অর্থাৎ খারাপ থেকে বাঁচা। অশ্বিনী এবং সরস্বতী নমুচি নামক রাক্ষসের পরাক্রম এবং বীর্যকে ইন্দ্রে পুনঃস্থাপিত করে ইন্দ্রকে মন্দ থেকে বাঁচিয়েছিল। যজুর্বেদের বক্তব্য হলো যারা যজ্ঞ করে না তাদের তেজ নষ্ট হয়ে যায়। নিজের তেজস্বিতাকে স্থির রাখার জন্য যজ্ঞক্রিয়া করুন...............যে এই অগ্নির চারদিকে বসে দিব্য উদ্দেশ্যে হবি প্রদান করে, তার হৃদয়ে পরমাত্মার তেজ প্রকাশিত হয়।১৮ আর মনুষ্য চারিত্রিক শুদ্ধতা প্রাপ্ত হয়। পুরুষদের চাইতে নারীদের দ্বারা এই আশা অধিক করা হয় যে সে নিজের ইন্দ্রসমূহের উপর নিয়ন্ত্রণ রেখে নিজের পতির প্রতি নিষ্ঠাবান হোক। যদি তার দ্বারা কোনো ভুল হয়ে যায় তবে তার জন্য "চাতুর্মস্য যাম" এ এক কাজ করা হত যার দ্বারা অধ্বর্যু যজমানের পত্নী থেকে পতির

–----------------------------

১৩. ঋগ্০ ১/৩৯/১০

১৪. ঋগ্০ ১/১২৪,১২৬,৭/১৮/২২ ২৫, ৮/৫/৩৭-৩৯

১৫. সেই ১০/১০৭/২,৭

১৬. তৈত্তি০ সং০ ৬/১/৬/৩

১৭. বৈ০ অনু০ মনোবৈ০ অনু০ প০ ১৩৪

১৮. যজু০ ৬/৭৫






পৃঃ- ১০৭



অতিরিক্ত অন্য কারো সাথে সম্ভোগ করার কথা জিজ্ঞেস করে, যদি সে এটা করে থাকে তবে সে তার নাম বলামাত্র দোষরহিত হয়ে যায়। তার করা দুষ্কৃতি থেকে সে মুক্তি পেয়ে যায়। তাণ্ড্য ব্রাহ্মণ অনুসারে এই যাগ করার মাধ্যমে যজমান তিন লোকে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।১৯ অতঃ যজ্ঞানুষ্ঠান দ্বারা সমাজে অনিন্দ্য গুণ, চারিত্রিক পবিত্রতা এবং নিষ্ঠা উৎপন্ন হয়।


নিজেকে ব্যক্তিদের চাইতে শ্রেষ্ঠতর সিদ্ধ করা এবং উন্নতি ও শ্রেয়ের প্রাপ্তির জন্য যাগানুষ্ঠানকে মহত্ত্বপূর্ণ মানা হয়। গীতার বক্তব্য হলো যজ্ঞের দ্বারা তুমি দেবতাদের উন্নত করো এবং সেই দেবগণ তোমাদের উন্নত করুন। পরস্পর উন্নতি করে শ্রেয়কে প্রাপ্ত হোক। নিজেকে শ্রেষ্ঠতম সিদ্ধ করার জন্যই "পুরুষমেধ" তথা "রাজসূয়" প্রভৃতি যাগের প্রারম্ভ হয়েছিল যেসবের আয়োজনের মাধ্যমে স্বরাজ্য প্রাপ্তি এবং স্বর্গ প্রাপ্তি করা যায়। তাণ্ড্য ব্রাহ্মণ তো এই অভিষেককে স্বর্গারোহণের সদৃশ মেনেছেন।২০ অশ্বমেধ-যাগের অনুষ্ঠাতা সশরীর স্বর্গ-গমনের অধিকারী হয়ে যায়।২১ সম্পূর্ণ বিশ্বে যজ্ঞকারীর যশের প্রসারও হয়ে যায়। সৈন্য বলের প্রদর্শনাত্মক বৃত্তির সাথে সাথে লোকৈষণার তৃপ্তিও হয়ে যায়। বাজপেয়-যাগকে করার মাধ্যমে স্বরাজ্যের প্রাপ্তি হয়- "বাজপেয়েন স্বারাজ্যকামো জয়েত।"২২ অর্থাৎ এই যাগকে করার পর যজমান স্বর্গ লাভ করে।২৩ এবং প্রজাপতির সমকক্ষ হয়ে যায়।২৪


যজুর্বেদের বক্তব্য- "যজ্ঞকারী স্বর্গসুখ প্রাপ্ত হয়, যার অভীষ্ট স্বর্গসুখ লাভ সে যেন এই যজ্ঞ করে।২৫ শতপথ ব্রাহ্মণ অনুসারে- " যজ্ঞ-অগ্নি-হোম নিশ্চয়ই স্বর্গসুখ প্রাপ্ত করানো বিশেষ নৌকা।"২৬ যজ্ঞই বিষ্ণু, যজ্ঞই প্রজাপতি এবং যজ্ঞই সূর্য। অন্ত এবং মীমাংসক বলেন- "অগ্নিহোত্রং জুহুযাত স্বর্গকামঃ। এক স্থানে তো এটাও বলা হয়েছে যে অগ্নিহোত্রের সম্পাদন দ্বারা সব যজ্ঞ স্বয়মেব অনুষ্ঠিত হয়ে যায়, সবচেয়ে প্রাপ্য ফল প্রাপ্ত হয়।২৭ ছান্দোগ্যোপনিষদে বলা হয়েছে যে যেভাবে ক্ষুদার্ত বালক সর্বদা মাতার নিকট যায়, সেভাবে প্রাণীও অগ্নিহোত্রের উপাসনা করে।২৮ দর্শপূর্ণমাস যাগের বিধান করার মাধ্যমেও স্বর্গ প্রাপ্তি হয় " দর্শপূর্ণমাসাভ্যাম স্বর্যজেত।"


অগ্নিষ্টোম প্রভৃতি যাগের আয়োজন করার মাধ্যমে সম্পূর্ণ কামনাসমূহের সিদ্ধি হয়। তাণ্ড্য ব্রাহ্মণে তো অগ্নিহোত্র কে "জ্যেষ্ঠযজ্ঞ" এর মহিমায় বিভূষিত করা হয়েছে।২৯ একদা ত্বষ্টার পুত্র বিশ্বরুপ ত্রিশিরার বধের মাধ্যমে হওয়া পাপ থেকে ইন্দ্র এই যজ্ঞ অনুষ্ঠান করে সেই পাপ মুক্ত হয়েছিল। এজন্য এই যজ্ঞের অনুষ্ঠান পাপ থেকে মুক্তি দায়ী।

—----------------------------------------

১৯. তাণ্ড্য ব্রা০ ১৭/১৩/৮ সায়ণভাষ্যমতে

২০. তাণ্ড্য ব্রা০ ১৮/১১/১০

২১. সেই ২১/৪/৩

২২. সেই ১৮/৭/১

২৩. সেই ১৮/৭/১২

২৪. সেই ১৮/৬/৪

২৫. যজু০ ১৮/৪/২

২৬. শত০ ব্রা০ ২/৩/৩/১৫

২৭. ষণ্ডিশ ব্রা০ ৫/১/৬-৯ তথা ৫/২/১

২৮. ছান্দো০ উপ০ ৫/২৪

২৯. তাণ্ড্য ব্রা০ ৬/৩/৮ "জ্যেষ্ঠযজ্ঞো বা এষ যদাগ্নিষ্টামঃ।






পৃঃ-১০৮


৩০। এর অনুষ্ঠান মুখ, বক্ষ, বাহু, মধ্যভাগ এবং চরণগত অশুদ্ধির নিবারণ করে ব্রহ্মবর্চস্ কে প্রদান করায়।৩১ যজমানের মালিন্যের নিবারণার্থ বায়ুর সাথে সম্বন্ধিত বিশেষ ঋচাসমূহ এই যাগে গাওয়া হয়। "যে অসুর প্রাণ এই পৃথিবীতে অসুররুপে বিচরণ করছে, যজ্ঞের বলি দ্বারা শরীর থেকে বের করা হয়।"৩২ পশুকামনার দ্বারাও এই যাগের আয়োজন করা হয়। প্রায়শ্চিত্ত স্বরুপও এই যাগ করার বিধান অনেক জায়গায় পাওয়া যায়।


স্পষ্ট যে বৈদিক ঋষিরা তথা অন্য ব্যক্তিরা স্বর্গাদি লোকে পৌছানোর ভব্য স্বপ্ন যজ্ঞানুষ্ঠানের মাধ্যমে বুঝিয়েছেন। বাস্তবে এই বিভিন্ন সুখের কামনা পূর্তিসমূহের আধার স্তম্ভ। জীবনকে উদাত্ত, উন্নত এবং ভব্য করার জন্য কর্মানুষ্ঠানের সুদৃঢ় আধার ভিত্তির উপর যজ্ঞের বিরাট স্বরুপের সংরচনা বেদে বিদ্যমান।


উপর্যুক্ত বিবেচনের আধারে আমরা দেখি যে মানব মনোবিজ্ঞান কে বুঝে (অর্থাৎ মানুষের ইচ্ছাসমূহ কী হয়, সে তাদের কি রুপে পূর্ণ করতে চায়) যজ্ঞের নির্মাণ করা হয়েছিল। এই যজ্ঞানুষ্ঠান অনেক ব্যয়বহুল ছিল, কিন্তু এর মধ্যে এই কথাও মাথা রাখা হয়েছে যে যে বর্ণের ব্যক্তির অনুষ্ঠান করার অধিকার রয়েছে, তার কাছে যেন সে পরিমাণ ধন আছে বা নেই। যেরুপ- রাজ্যপ্রাপ্তি, বিশ্ববিজয় দেওয়া অশ্বমেধ। রাজসূয় যজ্ঞ অধিকতর রাজা করতেন এবং তাদের কাছে ধনের কমতি ছিল না। এভাবে ব্রহ্মবর্চস ও স্বর্গপ্রাপ্তি করানো অগ্নিষ্টোম তথা অগ্নিহোত্র এত অধিক ধনব্যয়ী ছিল না। এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে যজ্ঞ সংস্থা কল্পনা মাত্র ছিল না, বরং মানব-মনোবিজ্ঞান, দেশ, কাল এবং পরিস্থিতিসমূহ তথা ধর্মের স্বরুপকে বুঝে এর নির্মাণ করা হয়েছিল। এজন্য যজ্ঞ সংস্থা এত বিকশিত এবং পল্লবিত হয়েছে যে বর্তমানকালেও মানব নিজের বিভিন্ন মনোস্কামনা পূরণের জন্য সময় সময়ে আলাদা-আলাদা প্রকারে যাগানুষ্ঠানের আয়োজন করতে থাকে।

–---------------------

৩০. সেই ১৭/২/২

৩১. সেই ১৭/৫/৬

৩২. যজুর্বেদ ২/৩০







পৃষ্ঠা-১০৯




              বৈদিক বাঙ্ময়ে কৃষি


মানব সমাজের জন্য আহার অপরিহার্য। পৃথিবী থেকে অন্ন, ফল, কন্দ-মূলাদির উৎপত্তি করাই কৃষিকাজ। চার বেদে যজ্ঞের মহিমা বর্ণিত রয়েছে, এই আধারের উপর বৈদিক সংস্কৃতিকে যজ্ঞীয় সংস্কৃতি বলা হয়। ঋগ্বেদে বর্ণিত রয়েছে যে জুয়ায় পরাজিত দূতকরকে ঋষি উপদেশ দিয়েছেন- জুয়া খেলা ছেড়ে দাও এবং ক্ষেতে কাজ করার অভ্যাস করো।২ ঋগ্বেদ অনুসারে অশ্বিন্ আর্যদের সর্বপ্রথম হল দ্বারা বীজ বোনার কৌশল শিখিয়েছে।৩



যজুর্বেদের ২২তম অধ্যায়ে নিকামে-নিকামে নঃ পর্জন্যো বর্ষতু ফলবত্যো নঃ ঔষধয়ঃ পচ্যন্তাম আদি বৈদিক রাষ্ট্রগীতে কৃষি-সংস্কৃতির শোভনীয় বর্ণন রয়েছে। যজুর্বেদের ২৩ তম অধ্যায়ে মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র ত্র‍্যম্বকম্ যজামহে সুগন্ধিম্ পুষ্টিবর্ধনম্ আদিতে প্রার্থনা রয়েছে যে ক্ষেতে স্বয়ং পাকার পর নিজের লতা থেকে পৃথক হওয়ার সারের বর্ণন পাওয়া যায় যা কৃষির মাহাত্ম্য বিশদতাপূর্বক বর্ণিত করে। অথর্ববেদে বর্ণিত রয়েছে-


জনং বিভ্রতী বহুধা বিবাচসং নানাধর্মাণং পৃথিবী যথৌকসম্।

সহস্রং ধারা দ্রবিণস্য মে দুহাং ধুবেব ধেনুরনপস্ফুরন্তী।।৪



এখানে পৃথিবীকে গাভীর মত দুধদাতা বলা হয়েছে। তার সহস্র স্তন হতে সে অন্ন, ঔষধ আদি দ্বারা সবার পোষণ করে। অথর্ববেদের যে সূক্তসমূহকে দেবতা বায়ু (২-৩০), সূর্য ১-১২,২-২১), চন্দ্র (২-২২), আপঃ (২-২৩), ত্বষ্টা (২-২৭), ঔষধী (২-২৭), অগ্নি (২-২৮), বৃহস্পতি (২-২৯), আদিত্য (২-৩২), বিদ্যুৎ এবং সিন্ধু, (১-১৫) আদি রয়েছে, এর দ্বারা স্পষ্টতই কৃষি সম্বন্ধীয় সংকেত পাওয়া যায়। অথর্ববেদেরই দশম কাণ্ডের ষষ্ঠ সূক্তের দেবতা ফাল্মণী। এই ফাল্মণীই হলো কৃষি দ্বারা উৎপন্ন অন্ন।


অথর্ববেদের যম, অগ্নি, ভূমি আদি দেবতাও কৃষি কাজের সাথে সম্পর্কিত। এভাবে ঔষধি সূক্ত তথা যেখানে যেখানে বনস্পতিদের উল্লেখ রয়েছে তা সবই কৃষির সাথে সম্বন্ধিত। অথর্ববেদে বর্ণন রয়েছে যে বৈবস্বত মনু শিশু ছিল এবং পৃথিবী দুধ দোহানোর পাত্র ছিল, সেই শক্তির দোহন বন্য পশুরা করেছিল, এর দোহন করে তারা ধান্য আদি পেয়েছিল। সেই কৃষি এবং ধান্যের উপরই মানুষ বেঁচে থাকে। অথর্ববেদের তৃতীয় কাণ্ডের ১৩তম সূক্তের দেবতা হলো সীতা। এই সূক্তে স্পষ্টতই বিধিপূর্বক কৃষি কাজের উল্লেখ রয়েছে। অথর্ববেদেরই সপ্তম কান্ডের ৭৫ তম সূক্তের দেবতা অধ্যাঃ, এখানে বর্ণিত আছে ইমং গোষ্ঠমিদং সদো ঘৃতেনাস্মান্তসমুক্ষত অর্থাৎ এখানে পশুপালনের অভীষ্টতার দিকে সংকেত পাওয়া যায়, যার দ্বারা প্রকারান্তর হতে কৃষিরই সংকেত পাওয়া যায়। বেদে আরো কতিপয় সূক্তের দেবতা কৃষির সাথে সম্বন্ধিত বলে মনে করা হয়। যথা- বৃষভ (৭-১১১), দূর্বা (৬-১০৬-২-৩), অনড়বান এবং গৌ আদি এই


—---------------------------------

১. অধ্যাপক (সংস্কৃত) বিদ্যালয়-বিভাগ, গুরুকুল কাংগড়ী বিশ্ববিদ্যালয়, হরিদ্বার

২. অক্ষৈর্মা দীব্যঃ কৃষিমিৎ কৃষস্ব। - ঋগ্বেদ - ১০-৩৪-৭,

৩. দশস্যন্তা মনবে পূর্ব্য দিবি যবং বৃকেণ কর্ষথঃ। - ঋগ্বেদ-০৮-২২-৬, 

৪. অথর্ববেদ -১২/১৪৫

৫. অথর্ববেদ- ০৮/১৩/৯-১২




পৃঃ-১১০



সূক্তসমূহে কৃষি সম্বন্ধীয় বর্ণনার সাথে সাথে বৈদিক সংস্কৃতির বর্ণন কৃষি সংস্কৃতির রুপে পাওয়া যায়।

যজুর্বেদে বর্ণিত আছে- মধুমান্নো বনস্পতির্মধুমাং অস্তু সূর্যঃ। মাধ্বীগোবো ভবন্ত নঃ।।৬ অর্থাৎ বনস্পতি আমাদের জন্য মধুময় হোক, সূর্য মধুমান হোক, ভূমিসমূহ মধুমতী হোক, সূর্য এবং ভূমি থেকে বনস্পতিসমূহে মধু উৎপন্ন হয়। ব্যক্তি সুবর্ণ ও পশু-ধনের সাথে সাথে কৃষিরও প্রচণ্ড কামনা করে। তথা ক্ষেত করে প্রচুর ধন-ধান্য পেতে চায়। যথা- কৃষিশ্চ মে বৃষ্টিশ্চ মে জৈত্রং চ ম ঔদ্ভিদ্যং চ মে যজ্ঞেন কল্পন্তাম্।৭ আমার ক্ষেত, বৃষ্টি, বিজয় এবং উন্নতি এই সব যজ্ঞ দ্বারা বৃদ্ধি পাক-সুসস্যাঃ কৃষিস্কৃধি৮ অর্থাৎ উত্তম ফল দ্বারা অথবা ধান্য দ্বারা যুক্ত কৃষিকাজ করো। এইসব মন্ত্রে কৃষি কাজেরই অনিবার্যতা এবং মহনীয়তার ভাব বিদ্যমান।


বেদে এরুপ অনেক মন্ত্র রয়েছে, যেখানে এই নির্দেশ পাওয়া যায় যে রাষ্ট্রবাসীদের কৃষিকে উন্নতি করাই সর্বদা প্রযত্নশীল থাকা উচিত। যথা- রয়িং বীরবতীমিষম্ ৯ অর্থাৎ হে অগ্নি তুমি আমাদের "ইয়" ১০ অর্থাৎ অন্ন প্রদান করো, যা গ্রহণ করে আমাদের পুত্র বীর হবে।


ঋগ্বেদে কৃষি-বিশেষজ্ঞদেরও বর্ণনা রয়েছে যারা ক্ষেতের ফলন বৃদ্ধি করতে চায়। এই ঋভু নামক বিদ্বান একে চার গুণ করতে সিদ্ধহস্ত হয়। ঋভুদের বলা হয়েছে- একং চমসং চতুরঃ কৃণোতন ১১ অর্থাৎ হে ঋভুগণ তোমরা এক অন্ন (চমসম)১১ কে চারগুণ করে দেয়।

যাভিঃ শচীভিশ্চমসাং অপিংশত যযা ধিয়া গামরিণীত চর্মণঃ ১৩ অর্থাৎ হে ঋভুগণ! তুমি নিজের যে বুদ্ধি দ্বারা (শচিভিঃ)১৪ অন্ন (চমসাম্)কে উৎপন্ন করো (অংপিশত) ১৫ এবং যে বুদ্ধি দ্বারা ভূমিকে (গাম্) উপরের ছিলে(চর্মণ) বাইরে বের করো। এর অর্থ এটাই যে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাসমূহ দ্বারা কৃষির পদার্থসমূহ পারস্পরিক যোগ-বিয়োগের মাধ্যম দ্বারা কঠোর খোসা ছাড়িয়ে ভূমিকে বাইরে বের করো। এখানে অন্ন (চমসম্) সাহচর্য দ্বারা গৌ এর অর্থ ভূমি তথা চামড়ার অর্থ ভূমির উপরের কঠোর পাপড়ি বা চামড়া করাই অভিষ্ট।

সুক্ষেত্রা কৃণ্বন্ননয়ন্ত সিন্ধূন্ ধন্বাতিষ্ঠন্নোষধির্নপ্নমায়ঃ ১৬ অর্থাৎ এই ঋভু জন ক্ষেতসমূহকে উত্তম করে তোলে নদীসমূহ (সিন্ধূন্) অর্থাৎ খাল চালিয়ে দেয়। এর দ্বারা মরুভূমি (ধন্ব) শস্য (ঔষধি) উৎপন্ন হতে থাকে এবং জলাশয় পানিতে ভরে যায়। রাজ্যে এরুপ কুশল শিল্পী রাখা উচিত যে রাষ্ট্রের কৃষিকে উত্তম এবং উপজাত করে মরুভূমি কেও বসতি স্থাপন করে অন্ন এবং জল দ্বারা যুক্ত করার উপায় ভাবতে থাকে। এরুপ দিগ্দর্শন বৈদিক-বাঙ্ময় অনেক মন্ত্রে পাওয়া যায়।

–--------------------

৬. যজুর্বেদ ১৩/২৯

৭. যজুর্বেদ- ১৮/৯

৮. যজুর্বেদ - ৪/১০

৯. ঋগ্বেদ- ১/৯৬/১১

১০. ইষমিতি অন্ননামিসু পঠিতম্ নিধ. ২/৭ অন্নং বা ইষম্ কৌ ২৮/০৫

১১. ঋগ্বেদ ১/১৬১/২

১২. ঋগ্বেদ- ৩/৬০/২

১৩. চমু অদনে। বেদেষু বহুধান্নোর্থে চমসঃ শব্দঃ প্রযুজ্যতে।

১৪. শ্চীতি প্রজ্ঞানামসু পঠিতম্- নিঘ. ৩/৯

১৫. পিশি অবয়বে ( কোনো বস্তুকে তৈরী রুপ দেওয়ায় এর প্রয়োগ হয়)

১৬. ঋগ্বেদ ৪/৩৩/৭







পৃষ্ঠা-১১১




বেদে ভূমির তিনটি প্রকার বর্ননা করা হয়েছে- ১. আর্তনা ভূমি ২. অপ্নস্বতী ভূমি এবং ৩. উর্বর ভূমি।


১. আর্তনা ভূমি- যা পাথরযুক্ত জলহীন এবং উর্বর হয় না, তাকে আর্তনা ভূমি বলে।

২. অপ্নস্বতী ভূমি- যে ভূমি অত্যন্ত উর্বর হয় তথা যেখানে সামান্য পরিশ্রম দ্বারা প্রচুর ধন-ধান্য উৎপন্ন হয়।

৩. উর্বর ভূমি- যেখানে প্রতিবছর হল চালানো হয় এবং যা ধন-ধান্যে পরিপূর্ণ থাকে।


ঋগ্বেদে বর্ণিত আছে যে ক্রিয়াশীল সুখপূর্বক নিকটস্থ ঘরে গিয়ে বাস করো। ১৭ জল রহিত মরুভূমি এবং কৃষিকাজযোগ্য উর্বর ভূমির মধ্যে পার্থক্য কি? কৃষি দ্বারা অন্ন উৎপন্ন করার জন্য ভূমিতে যে প্রথম কাজ করা হয়, সেই ভূমি-কর্ষণ অর্থাৎ ভূমির চাষ হয়।


ঋগ্বেদ অনুসারে কৃষির জন্য ভূমির যত শিক্ষাই রয়েছে তা সর্বপ্রথম অশ্বিনী দেবতাগণ দিয়েছেন।১৮ অথর্ববেদে বলা হয়েছে যে- পৃথিবী বন্যরা সর্বপ্রথম কৃষিকাজ দ্বারা শস্য উৎপন্ন করা শুরু করেছিল।১৯ বেদে কর্ষণ কাজ সম্পন্নকারী হলের জন্য লাঙ্গল, শ্রোণী এবং মাথা আদি শব্দের প্রয়োগ করা হয়েছে। হলের ফলকে বেদে যুগ শব্দ দ্বারা পরিভাষিত করা হয়েছে।


ঋগ্বেদে বোনা বীজ এবং এর দ্বারা উৎপন্ন হওয়া অন্নকে যবংকৃত তথা শস্য বলা হয়েছে। কৃষির জন্য উপযোগে নেওয়া অনেক সাধনার উল্লেখ বৈদিক-বাঙ্ময়ে বর্ণিত আছে। শতপথ ব্রাহ্মণে চাষ, বোনা, কাটা আদি বিভিন্ন কৃষিকাজের উল্লেখ কৃষন্তঃ বপন্তঃ, লুনন্তঃ তথা মৃণন্ত রুপে বর্ণিত আছে।


কৃষির অন্য সাধনা রুপে- হল-সীর, সীল,লাঙ্গল,জুয়া যুগ, কৃষক-কীনাশ এবং সীরপতি, ফালি-সীতা(ঋষি দয়ানন্দ যজুর্বেদ ভাষ্য ১২.৭০ এ সীতার অর্থ কাষ্টপট্টিকা অর্থাৎ পটেলা করেছেন)



এর প্রয়োগ করা হত। ঋগ্বেদে অনেকবার এর বর্ণন পাওয়া যায়, এটি বেশিরভাগ লাকড়ি তথা লোহার নির্মিত হত।


কৃষির ভোজন রুপে উর্বরক সার (গোবরের সার) যজ্ঞীয় সার তথা জল-সেচন (সিঞ্চন) এর বর্ণনও বৈদিক-সাহিত্যে পাওয়া যায়।


বেদে অন্ন, অন্ধ, বাজ,ইরা, শ্রবঃ, পয়ঃ, পিতু, সুতঃ, পৃক্ষঃ, সিনম্, অবঃ, ইষম্, ইড়া, অর্ক, রসঃ, স্বধা, অর্ক, ক্ষদম, নেমঃ, শষম্, নমঃ, আয়ুঃ, সূনৃতা, বর্চ, ব্রহ্ম, কীলালম্, আজ্যম্, হবিঃ, দ্যুম্নম্, ভক্ষঃ, উখ্যঃ, ধান্যঃ, পাথঃ, আদি অন্নবাচিক শব্দ দেখা যায়। সেই নানা প্রকার অন্নের বুনন, কাটা এবং এর উপয়োগের জ্ঞান তৎকালীন ব্যক্তিদের ছিল। বৈদিক যুগে মুখ্য অন্ন যে (যব) তথা দ্বিতীয় অন্ন (ব্রীহি) চাল ছিল। 



শতপথ ব্রাহ্মণে ফসলের কাস্তে(দাত্র এবং সৃণি) দ্বারা কেটে যাওয়া, তাকে গর্তের মধ্যে বেঁধে রাখা "বর্প" এবং

—-------------------------

১৭. ঋগ্বেদ ১০/৮৬/২০

১৮. ঋগ্বেদ ১/১১৩/২১

১৯. অথর্ব ৮/১০/১১

২০. অথর্ববেদ ৩/১৭/৬







পৃঃ ১১৩



কৃষ্টিজানামোষধীনাং জাতানাং চ স্বয়ং বনে। 

বৃথালম্ভে'নুগাছেদ্ গাং দিনমেকং পয়োব্রতঃ। ২৯


অথর্ববেদের পৃথিবী সূক্তে বলা হয়েছে হে ভূমি! তোমার বৃক্ষদের মধ্যে এভাবে বিচ্ছিন্ন করার সেই শীঘ্রই পুনঃ অঙ্কুরিত হয়ে যায়। সম্পূর্ণ রুপে কেটে তোমার মর্মস্থল বা হৃদয়ে যেন আঘাত না করে বসি। যথা

 

যৎ তে ভূমিং বিখনামি ক্ষিপ্রং তদপি রোহতু।

মা তে মর্ম বিমৃগ্বরি মা তে হৃদয়মর্পিপম।।৩০


বনস্পতিসমূহকে সমূলে নষ্ট করা হলো ভূমির মর্ম বা হৃদয়ে প্রহার করা। বৃক্ষ, বনস্পতিসমূহ বায়ুমন্ডল শোধনের কাজ করে।


অথর্ববেদের ভূমি সূক্তে বর্ণিত আছে যে "অরণ্য তে পৃথিবী স্যোনমস্তু"৩১ অর্থাৎ হে বনস্পতি তোমার জঙ্গল আমাদের জন্য সুখদায়ী হোক। "মাতরম্ ঔষধীনাম্"৩২ অর্থাৎ ভূমির ঔষধিসমূহের মাতা বলা হয়েছে, এর মধ্যেই বৃক্ষ ও ঔষধিসমূহ স্থির রুপে থাকে। "যস্যাং বৃক্ষা বানস্পত্যা ধ্রুবাস্তিষ্ঠন্তি বিশ্বহা।"৩৩


ঋগ্বেদে বর্ণিত আছে যে বনে বনস্পতিসমূহকে প্রচুর মাত্রায় ফলাও,বন হতে সুস্বাদু ফল এবং অন্নের প্রাপ্তি হয়। তাই যে কৃষি দ্বারা হবনীয় অন্ন প্রাপ্তি হয়, অরণ্য হতে ঔষধিসমূহ, সমিধার চারণভূমি এবং বাগান হতে অনেক রকম এর বাদাম পাওয়া যায়,,,এ সমস্তকিছুই কৃষির আধার। বেদে ভূমিকে মাতাভূমিঃ পুত্রোহং পৃথিব্যাঃ এর রুপে অভিব্যক্ত করা হয়েছে। যেভাবে মায়ের রক্ত, মাংস আদি থেকে বালকের দেহ নির্মিত হয়, সেভাবে ভূমি হতে উৎপন্ন হওয়া অন্ন, জল, বায়ু তথা বনস্পতিসমূহ হতে সেখানে থাকা প্রাণীরাও উৎপন্ন হয়। প্রাচ্যকালে প্রচলিত গৌমেধ যজ্ঞ এক প্রকার কৃষি মহোৎসব। বেদে মূলত পৃথিবীর জন্যই গৌ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এভাবে গৌ-পৃথিবী, গৌ-পশু, এ দুটোই কৃষির সাধনভূত প্রমাণ।


অথর্ববেদের দ্বাদশ কাণ্ডে প্রথম সূক্ত যাকে ভূমি অথবা মাতৃভূমি সূক্ত বলা হয়, সেই ভূমি উন্নত কৃষিকাজের জন্য সম্পূর্ণ উপযুক্ত। যে ভূমিতে চাল, যব আদি উৎপন্ন হয় এবং আহারের পদার্থ যেখানে অগণ্য তথা যেখানে পাঁচ প্রকারের মানুষ কৃষিকাজ করে বাস করে এবং যেখানে অনেক বছর ধরে অন্নাদি উৎপন্ন হয় এবং বর্ষার মাধ্যমে যে ভূমির পালন করা হয়, সেই মাতৃভূমি বা ভূমি সকলের জন্য বন্দনীয়।


হে ভূমে! তোমার মধ্যে হল চাষ করে আমরা যা বপন করেছি তা শীঘ্রই বেড়ে উঠুক।" যে ভূমি অথবা মাতৃভূমির ক্ষেতে বিশেষ পরিশ্রম করা হয় এবং যে ভূমিতে আমরা অন্ন উৎপন্ন করি, সেই ভূমি আমাদের গাভী এবং অন্ন প্রদান করবে।"


—-------------

২৯. মনুস্মৃতি ১১/১৪৪

৩০. অথর্ববেদ ১২/১/৩৫

৩১. অথর্ববেদ ১২/১/১১

৩২. অথর্ববেদ ১২/১/১৭

৩৩. অথর্ববেদ ১২/১/২৭

৩৪. অথর্ববেদ ১২/১/৪২

৩৫. অথর্ববেদ ১২/১/৪৩









পৃষ্ঠা-১১৪



ভূমি সূক্তের এই মন্ত্রসমূহকে দৃষ্টিগত করার মাধ্যমে এটা বোঝা যায় যে ভূমিতে শ্রদ্ধাপূর্বক পরিশ্রম করে কৃষি দ্বারা বিভিন্ন অন্নসমূহের উৎপাদন কারী মানুষ বলে যে- হে ভূমি মাতা! তুমি আমাদের হিংসা করো না এবং আমরাও তোমায় হিংসা করব না।"৩৯ বেদ মানুষকে প্রেরণা দেয় যে তুমি উৎকৃষ্ট খাদ্ আদির দ্বারা ভূমিকে পোষক তত্ত্ব প্রদান করো। ভূমিকে দৃঢ় করো এবং ভূমিকে হিংসা করো না।"৪০

ভূমির হিংসা করার অভিপ্রায় হলো তার পোষক তত্ত্বকে অনবরত ফসল দ্বারা এতটা বেশি টানা যে সে ভূমি আর ফসল ফলানোর উপযুক্তই না থাকে। এর নিবারণের জন্য ভূমিতে ফসল পরিবর্তন করে চাষ করা তথা বিধিপূর্বক পুষ্টিকর সার দেওয়। আজ পাহাড়, সমভূমি এবং নদীসমূহের তট হতে বৃক্ষ এবং জঙ্গল কাটার ফলে ভূমির দৃঢ়তা সমাপ্ত হচ্ছে। যদি আমরা বৃক্ষাদি না কেটে নতুন গাছ লাগাই তবে মাটির দৃঢ়তা থাকে, এটার তার অহিংসিত ভাব। ভূমি বা ভূতলের মাটিতে কোনো কমতি থাকে তবে প্রজাপতি রাজা বিভিন্ন উপায় দ্বারা সেই কমতি দূর করে।"৪১ ভূমির রক্ষণ এবং সংবর্ধন সবার কর্তব্য, যার দ্বারা এই ভূমি অন্ন উৎপন্ন কারী ঔষধিসমূহের মাতা এবং বিশ্বধাত্রী হয়ে থাকে।৪২ অথর্ববেদ অনুসারে, ভূমির কোল অর্থাৎ তার ধরাতল এবং ভেতরের অবয়ব আমাদের জন্য পোকাযুক্ত এবং রোগোৎপাদক যেন না হয়।৪৩

যজুর্বেদে বর্ণিত আছে যে শায়িত ভূমির হৃদয় যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়, তবে মাতরিশ্বা বায়ু তাতে পুনঃশক্তি সন্ধান করে দেয়।৪৪ যদি ভূমির উর্বর শক্তি কমে যায় বা শেষ হয়ে যায়


তবে কিছু সময় তাতে কৃষি না করে তা খালি রেখে শুদ্ধ বায়ু, সূর্য-রশ্মিসমূহ, বর্ষা আদির দ্বারা তাতে পুনঃশক্তি এসে যায়। ভূমির সংবর্ধন এবং সংরক্ষণ জলেরও মাহাত্ন্যপূর্ণ স্থান।

ঋগ্বেদে বর্ণিত আছে হে নদীসমূহ! উত্তম অন্ন উৎপন্ন করে ঐশ্বর্য বৃদ্ধিকারী খালদের তুমি জলরুপে পূর্ণ করে দাও। খালের জন্য বক্ষণা ও কুল্যা শব্দের প্রয়োগও বেদে পাওয়া যায়। নিরুক্তে ঘৃতের অর্থ জল করা হয়েছে।


ঋগ্বেদ অনুসারে ইন্দ্র বা বজ্রী বৃষভো ররাদ তা আপো দেবীরিহ সামবন্তু ৪৬ অর্থাৎ বজ্রধারী সুখের বর্ষক ইন্দ্র যা খুড়ে বয়ে চলে, সেই কৃষ্যাদি ব্যবহারোপযোগী জল আমার তথা রাষ্ট্রের রক্ষা করুক তথা জল মিলে ক্ষীণ হওয়া কৃষি আদিকে উন্নত করুক।

শতপথ ব্রাহ্মণে বর্ণিত আছে যে প্লবনশীল কৃষি আদিকে সিঞ্চিত করে উপযোগী করো।৪৭ ঋগ্বেদেই বলা হয়েছে- জল দ্বারা পূর্ণ ভালোভাবে সিঞ্চন যোগ্য কখনো যার জল কমে যায় না, এরুপ কূপ দিয়ে ক্ষেত সিঞ্চন করো।

–-------------

৩৮. সা নো ভূমির্গোষ্বপ্যত্রে দধাতু। অথর্ববেদ ১২/২/৪

৩৯. পৃথিবী মাতর্মা মা হিংসীর্যো অহং ত্বাম। যজুর্বেদ ১০/২৩

৪০. পৃথিবীং যচ্ছ, পৃথিবীং দৃহ, পৃথিবীং মা হিংসী। যজুর্বেদ ১৩/৮

৪১. যত্ত ঊনং তত্ত আ পুরয়াতি প্রজাপতিঃ প্রথমজা ঋতস্য৷ অথর্ববেদ ১২/১/৬১

৪২. বিশ্বস্য মাতরমোসধীনাং পৃথিবীং বিশ্বধায়সং ঘৃতমচ্ছ বদামসি। অথর্ববেদ ১২/১/১৭

৪৩. উপস্থাস্তে অনমীবা অযক্ষ্মা। অথর্ববেদ ১২/১/৬২

৪৪. সং তে বায়ুর্মাতরিশ্বা দধাতু- উত্তানায়া হৃদয়ং যদ্ বিকস্তম্। যজুর্বেদ ১১/৩০

৪৫. প্র পিন্বধ্বমিষয়ন্তী সুরাধা আ বক্ষণাঃ পৃণধ্বং যাত শীভিম্। ঋগ্বেদ-৩/৩৩/১২

৪৬. ঋগ্বেদ ৭/৪৯/১

৪৭. ১১/৫/১/৪ শতপথ ব্রাহ্মণ।










পৃঃ-১১৫


করুক।" খাল এবং কূপের সমান পুকুর কে সিঞ্চনের মুখ্য সাধন মানা হয়। ছোট ছোট খালের থেকে বড় পুকুরের মধ্যে পানি একত্রিত করে এর দ্বারা কৃষির সিঞ্চন করা হয়। খাল কে গোরুপ নদীর বৎস বলা হয়েছে। বেগবতী ধারাসমূহ সমুদ্রে যায়, নালা পুকুর কে প্রাপ্ত হয়ে এবং আকাশ থেকে পড়া বৃষ্টিরুপী দান দ্বারা কৃষক কৃষি দ্বারা যব আদির বৃদ্ধি করেন।"


উপসংহার

বেদে কৃষি সম্বন্ধীয় বিষয়ে বিশদ বিবেচনা পাওয়া যায়। বৈদিক বাঙ্ময়ে বর্ণিত অন্নের মাহাত্ন্য এবং অন্ন প্রাপ্তি রাষ্ট্রের জন্য অন্নের মাহাত্ন্য এবং অর্থ শুচিতাকে প্রতিপাদিত করে। ব্রাহ্মণ গ্রন্থে অন্নকে ব্রহ্ম বলা হয়েছে। মহর্ষি দয়ানন্দ অন্ন উৎপাদনকারী কৃষককে রাজাদেরও রাজা বলেছেন। বৈদিক আর্যরা কৃষিজীবী ছিল। ঋগ্বেদ অনুসারে কৃষ্টি শব্দ দ্বারা আর্যদের কৃষক হওয়ার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। কৃষিকে আপন করে নেওয়া শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ। বেদ অক্ষৌর্মা দিব্য কৃষিমিৎ কৃষস্ব বলে কৃষির মাহাত্ন্য বর্ণনা করেছে। কৃষি কাজ না করা ব্যক্তি অথবা তাদের নীচু দৃষ্টিতে দেখা ব্যক্তিদের সমাজে উচু স্থান প্রাপ্তি হয় না। আগেরকার দিনে অর্থোপার্জন এর মুখ্য সাধন কৃষিই ছিল। কৃষি দ্বারা মানব নিজের এবং রাষ্ট্রের উন্নতিতে প্রযত্নশীল থাকে। কৃষি থেকে যেখানে অন্নৌষধি প্রাপ্তি হয় সেখানে মানবীয় জীবন সুখকারী ও প্রগতিশীলও হয়। বর্তমান সময়েও যদি বেদোক্ত কৃষি সংসাধনকে উলঙ্ঘন করর সর্বোত্তম কৃষিকর্মের জীবনের ব্যবস্থা করা হয় তবে অর্থ সুচিতার সাধনরুপে কৃষি রাষ্ট্রোন্নতির মুখ্য ঘটকই সিদ্ধ হয়।


कोई टिप्पणी नहीं:

एक टिप्पणी भेजें